নগরীর দক্ষিণ খুলশী এলাকার সরদার বাহাদুর লেইনে গত ১০ থেকে ১২ বছর ধরে ওয়াসার পুরানো লাইন আছে, কিন্তু এলাকাবাসীর বেশিরভাগই পানি পান না। এই দীর্ঘ সময়ে এলাকাবাসী পানি না পেলেও কিন্তু প্রতিমাসে ওয়াসা বিল দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার সরদার বাহাদুর লেইনের বাসিন্দা নোমান–ই আলম খান।

গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম ওয়াসার গণশুনানিতে তিনি এই অভিযোগ করেন। শুনানিতে তিনি পানি সরবরাহ না করেও ওয়াসা বছরের পর বছর যে বিল দিয়েছে, তা মওকুফ করার জন্য ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহর আছে আহ্বান জানান। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে আয়োজিত গণশুনাননি ও সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় ভুক্তভোগী নোমান–ই আলম খানের মতো একাধিক গ্রাহক অসংখ্য অভিযোগ এবং সেবার মান বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব দেন।

শুনানির শুরুতেই ওয়াসার গ্রাহক নোমান–ই আলম খান অভিযোগ করে বলেন, সরদার বাহাদুর লেইন এলাকার অনেক বাসিন্দার কাছে বছরের পর বছর পানি যায় না, অনেক পুরনো লাইন। কিন্তু পানি না থাকার পরও বিল দেওয়া হয়। এরকম লাখ লাখ টাকার বিল জমে আছে। তিনি বলেন, আমরা পানি পেলাম না–তাহলে বিল কেন দেবো? পাশাপাশি তিনি বলেন, আমি সরদার বাহাদুর লেইন এবং আগ্রাবাদ সিডিএ এই দুই এলাকার বাসিন্দা। আমি থাকি আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকায়। সেখানে ওয়াসার নতুন লাইন স্থাপন করা হয়নি। সেখানে অনেক বাসা–বাড়িতে মাঝে মধ্যে দুর্গন্ধযুক্ত পানি পাওয়া যায়।

জবাবে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, পানি না পেলেও লাইন চার্জ হিসেবে একটি ফি দিতে হয়, এটা কিন্তু বিল না, লাইন চার্জ। আপনি যদি সংযোগ রাখেন এজন্য একটা লাইন ফি দিতে হয়। আপনারা–আমরা যারা বাসায় টিএন্ডটি ব্যবহার করি–আমরা কল না করলেও প্রতিমাসে একটা লাইন চার্জ দিই। ওয়াসার ক্ষেত্রেও তাই। আপনি যদি সংযোগ রাখতে চান–তাহলে প্রতিমাসে লাইন চার্জ দিতে হবে। আর যদি আপনি সংযোগ রাখতে না চান, আমাদেরকে বলেন, আমরা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবো। তখন আর এই চার্জ দিতে হবেনা।

সরদার বাহাদুর লেইনে আগামী ৫/৬ মাসের মধ্যে ট্যাঙ্ক স্থাপন করে পানি সরবরাহ স্বাভাবিক করার আশ্বাস দিয়ে ওয়াসার এমডি বলেন, রেলওয়ের সাথে কথা হয়েছে সেখানে ট্যাঙ্ক স্থাপনের জন্য জায়গাও পাওয়া গেছে।

এদিকে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ নেই দাবি করে এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, আমাদের লাইনে কোথাও লিকেজ নেই। আমাদের লাইন দিয়ে ময়লা পানি ঢুকার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই ক্ষেত্রে হয়তো বাসা–বাড়িতে নিজেরা যেসব পাইপ দিয়ে পানি নিচ্ছে সেগুলো দুর্বল পাইপ হওয়ার কারণে সেখান দিয়ে ময়লা পানি ঢুকছে। আমাদেরকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে আমরা নমুনাসহ অভিযোগ করলে তারা ব্যবস্থা নেবেন। তিনি বলেন, বেশিরভাগ জায়গায় জাইকার পাইপ স্থাপন করা হলেও কিছু কিছু জায়গায় করা সম্ভব হয়নি। নতুন প্রকল্পে সেসব এলাকায় পাইপ লাইন স্থাপন করা হয়নি, কয়েক মাসের মধ্যে নতুন লাইন স্থাপনের আশ্বাস দেন তিনি।

কদমতলী এলাকার ওয়াসার গ্রাহক ও চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার পরিচালক মো. নাসির মিয়া বলেন, আমাদের কদমতলী এলাকায় আগে পানি পেতাম না। আগে সরবতের মতো পানি আসতো। এখন সপ্তাহে ২/৩ দিন পানি পাই। প্রতিদিন যেন পানি পাই, সেই ব্যবস্থা করার জন্য আহ্বান জানান তিনি। জবাবে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, এই এলাকাটি নতুন প্রকল্পের মধ্যে পড়েছে। পরবর্তী প্রকল্পে নতুন পাইপ লাইন হবে এবং প্রতিদিন পানি পাবেন।

সাংবাদিক হামিদ উল্লাহ চট্টগ্রাম ওয়াসার সিস্টেম লস কমানোর পরামর্শ দেন। জবাবে ওয়াসার এমডি বলেন, আগে চট্টগ্রাম ওয়াসায় ৫০ শতাংশ সিস্টেম লস ছিল। পরবর্তীতে কমিয়ে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ছিল, এখন একটু বেড়েছে। এবছরের মধ্যে আমরা ২০ শতাংশের মধ্যে নিয়ে আসবো।

ইসমত আরা ইতি অভিযোগ করে বলেন, ওয়াসায় আমরা সামান্য একটু তথ্যের জন্য যে কোনো অফিসারকে ফোন করলে তারা তথ্য দেননা, তারা বলেন, এমডির কাছে যান। তথ্য অধিকারে আবেদন করেন। আমরা তো একটি নিউজের জন্য একটি তথ্যের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সাহেবকে ফোন করলেও ফোন রিসিভ করে কথা বলেন। কিন্ত ওয়াসার কর্মকর্তারা কোনো তথ্য দিতে চাননা। এর জবাবে ওয়াসার এমডি একেএম ফছলুল্লাহ বলেন, সাংবাদিকদের যে কোনো তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কর্মকর্তাদের প্রতি বাধা নিষেধ নেই। যদি কেউ কোনো তথ্য দিতে না চান তাহলে সরাসরি আমার কাছে আসবেন। আমার দপ্তর আপনাদের সবার জন্য উন্মুক্ত।

আদর্শ পাড়ার বাসিন্দা গ্রাহক স্টালিন দে অভিযোগ করে বলেন, মিমি সুপার মার্কেটের পেছনে আর্দশ পাড়ায় ওয়াসার পানির প্রেসার দিলে বিভিন্ন জায়গায় লাইন ফেটে রাস্তা ভেসে যায় পানিতে। হালিশহর আই ব্লক আাবাসিক এলাকার সাধারণ সম্পাদক বলেন, ওয়াসা রাস্তা কেটে রেখেছে অনেক দিন হয়েছে। রাস্তাটা এখনো ঠিক করা হয়নি। মানুষ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারছে না। এসময় প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, আমরা রাস্তা কাটার ক্ষতিপূরণ সিটি কর্পোরেশনকে দিয়ে থাকি। আমরা সিটি কর্পোরেশনকে বলে দেবো রাস্তাটি খুব দ্রুত মেরামত করে দেয়ার জন্য।

১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া এলাকার এক বসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, আগে আমরা নিয়মিত পানি পেতাম। এখন আমাদের এলাকায় মোটর ছাড়া পানি পাওয়া যায়না।

শুষ্ক মৌসুমে ওয়াসার পানিতে লবণাক্ততার বিষয়ে আরেক গ্রাহকের প্রশ্নের উত্তরে ওয়াসার এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ওয়াসার পানি মূলত দুইটি নদী থেকে তোলা হয়। শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় পানির স্রোত কম থাকে। অন্যদিকে সমুদ্রের নোনা পানি ওপরে উঠে আসে। ফলে লবণাক্ততা বাড়ে। প্রাকৃতিক এসব সমস্যার কারণে মিষ্টি পানির সংকট হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে আরও একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন আছে। পাশাপাশি কাপ্তাই লেকে ড্রেজিং করার প্রস্তাব দেন তিনি।

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো ওয়াসায় অনিয়ম আছে, তবে তা সহনীয় পর্যায়ে। গ্রাহক হয়রানি কমিয়ে আনতে আমরা চেষ্টা করছি। কেউ অভিযোগ দিলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করি। তিনি আরও বলেন, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় চট্টগ্রাম ওয়াসায় অনিয়মের পরিমাণ অনেক কম। আমাদের দরজা খোলা আছে, যে কোনো যে কেউ আমাদের কাছে আসতে পারে। আমার কাছে এসে যদি কেউ প্রতিকার না পায়, তাহলে বলার সুযোগ থাকে আমি দুর্নীতিতে জড়িত আছি। কিন্তু আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করছি। গণশুনানিতে চট্টগ্রাম ওয়াসার অনেক গ্রাহক পানির বিল নিয়ে অভিযোগ জানালে তা দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দেন তিনি।

এর আগে লিখিত বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ। এসময় তিনি চট্টগ্রাম ওয়াসার চলমান ও সদ্য শেষ হওয়া প্রকল্পগুলোর সর্বশেষ অবস্থা সবার সামনে তুলে ধরেন। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে ওয়াসার সেবার মান বাড়বে বলে তিনি জানান।

সভায় ওয়াসার এমডি দাবি করেন, ২০০৯ সালে ৩৭ কোটি লিটার চাহিদার বিপরীতে ওয়াসার উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১২ কোটি লিটার। বর্তমানে ৪৮ কোটি লিটার চাহিদার বিপরীতে সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি লিটার। তিনি জানান, চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উৎপাদন ব্যবস্থা আইএসও সনদ পেয়েছে, যেটি বাংলাদেশে আর কোনো সংস্থার নেই।

তিনি আরও দাবি করেন, পানির গুণগত মান ঠিক রাখতে প্রতিমাসে নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে ২৪০টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়।

এছাড়াও ওয়াসার বাস্তবায়িত, বাস্তবায়নাধীন এবং প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর তথ্য তুলে ধরেন তিনি।

গণশুনানিতে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম ওয়াসার উপ–ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রকৌশল) বিষ্ণু কুমার সরকার, উপ–ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) শাহিদা ফাতেমা চৌধুরী, প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম।

Share Now
November 2025
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930