গভীর এবং তিক্ত মেরুকরণের কোনো সমাধান আছে কি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ? এমন প্রশ্নের উত্তর হয়তো আসবে- হ্যাঁ, আছে। কিন্তু সেটা কাজ করছে না। এই সমাধানটি হয়তো সংকটের আকারে আসতে পারে। এই মুহূর্তে, দেশটি তার একশ’ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে করোনা সংক্রমণের পর এখনো পর্যন্ত সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটি ছুঁই ছুঁই করছে। এর মধ্যে ৩ লাখ ২০ হাজারের বেশি নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে এবং দিনে দিনে এই সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সারা বিশ্বের মধ্যে দেশটি সর্বাধিক খারাপ অবস্থানে রয়েছে। তবুও যুক্তরাষ্ট্র আগের চেয়ে আরো বিভক্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার সংকট মোকাবিলায় স্বভাবতই ভালো কাজ করে।
যখনই তারা বাধার সম্মুখীন হয়েছে তখনই তারা সেই সংকট মোকাবিলা করে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে। সঠিক পরিস্থিতিতে বাধা ভেঙে তারা এগিয়ে গিয়েছে। ঠিক এমনই পরিস্থিতি এবারের অর্থনৈতিক উদ্দীপনা বিলেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
১৯৫৭ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন স্পুটনিক নামে তাদের প্রথম মহাকাশ উপগ্রহ চালু করেছিলো, তখন যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা হতবাক হয়েছিল। এর ফলে মার্কিন ফেডারেল সরকার শিক্ষা খাতে গভীর মনোযোগী হয়। এ বিষয়টিকে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় একটি দায়বদ্ধতা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলায় সৃষ্ট সংকটের পরেও এমনটি ঘটেছিল। ধ্বংসাত্মক সন্ত্রাসী ওই আক্রমণ দেশের গভীরে রাজনৈতিক বিভাজনকে আরো ত্বরান্বিত করেছিলো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০১ সালের ৯/১১-এর প্রায় এক বছর পর প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ যেসব কাজ করছিলেন, তাতে সমর্থন ছিল বেশির ভাগ ডেমোক্রেটের।
হামলার এক বছর পর অর্থাৎ ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে যখন বুশ প্রশাসন ইরাক আগ্রাসনের ঘোষণা দিয়েছিলো, তখনই তাদের সুবোধ যুগের অবসান ঘটেছিলো। ইরাক যুদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্তে পুরনো সব বিভক্তি নতুন করে জেগে ওঠে। যেন আরো একটি ভিয়েতনাম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো। দেশটির রাজনীতিবিদরা সবসময় এমন বিতর্কিত বিষয়গুলোকে সংকটে পরিণত করার চেষ্টা করে থাকেন- এই যেমন পরিবেশ সংকট, শিক্ষা সংকট বা শক্তি সংকট- যা-ই হোক না কেন সমস্যা নিরসনের একমাত্র সমাধান হিসেবে তারা যুদ্ধকেই বেছে নিয়ে ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেন। যেমন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, অপরাধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। দেশটি তাদের জনমত নির্ধারণের জন্য সংকট নিরসনে যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো উপায় যেন সেখানে কাজ করবে না। ব্যাপারগুলোকে সেভাবে সাজানো হয়নি।
এই করোনা মহামারিও অবশ্যই একটি বড় সংকট হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। কারণ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশটিতে প্রতিদিন হাজার হাজার নাগরিক মারা যাচ্ছেন, অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে, ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, খাবারের সংকট, বিনোদনের অভাব, প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের সঙ্গে মিলিত হতেও বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাহলে এটি কি কোনো সংকট নয়? সঙ্গত কারণে উত্তর হবে- অবশ্যই। এটি একটি বড় সংকট। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এবং তার সমর্থকরা এই সংকটকে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান। জাতির এই জরুরি সংকটের সময় পুরো দেশকে একত্রিত না করে তারা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেছে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে বিজ্ঞানের বিশ্লেষণকে নিয়েও বিতর্ক ছড়িয়ে গেছে রাজনীতিতে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিটি সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে ভঙ্গ করে বিষয়টি আরো অনিয়ন্ত্রিত করে তোলেন। যেমন- লক ডাউন, মাস্ক ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব মানা, বাড়িতে অবস্থান করাসহ বেশির ভাগ নিয়মই লঙ্ঘন করেছেন। তার সমর্থকরা এসব নিয়ে অভিযোগ করে বলেন, সরকার আমাদের বড়দিনের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিধিনিষেধ নিয়ে বিতর্কটি এখন ‘কোভিড কালচারাল ওয়ার বা কোভিড যুদ্ধে’ পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে উস্কানি দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন বিষয়টিকে আরো বেশি হাস্যকর করেছে। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় হোয়াট হাউসেই বিশাল নির্বাচনী সমাবেশ করে। সেখানে সামাজিক দূরত্ব মানার কোনো ছিটেফোঁটাও ছিল না। এই ইভেন্টগুলো মূলত পরবর্তীতে করোনা সংক্রমণে ‘সুপার স্প্রেডার’ হিসেবে কাজ করেছে।
তাছাড়া দেশটিতে করোনার টিকা অনুমোদনের বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসনকে অনেকটা বিশ্রী পরিস্থিতিতে ফেলেছে। করোনাভাইরাসের টিকা বিতরণের জন্য গঠিত অপারেশন ওয়ার্প স্পিডের কৃতিত্ব নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাহলে ঘটনা কি ঘটছে? করোনাভাইরাসের টিকা বিরোধী একটি আন্দোলন মার্কিনিদের মধ্যে গড়ে উঠছে। তারা টিকায় আস্থা রাখে না। একই সঙ্গে টিকা নেয়ার বিরোধিতা করে। মার্কিনিদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক এখন এই টিকা নেবেন বলে সুনির্দিষ্ট করে জানিয়েছেন।
টিকাবিরোধী বিক্ষোভ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনা মহামারির বিধিনিষেধ মানতে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য নিউ ইয়র্ক সিটির একটি বার-এর মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লং আইল্যান্ড ম্যানসনে একটি পার্টি আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে যোগ দিয়েছিলেন ৪০০ অতিথি। সেই পার্টি ভেঙে দিতে সেখানে পুলিশ ডাকা হয়েছিল। যখন লস অ্যানজেলেস কাউন্টির স্বাস্থ্য বিভাগ সেখানকার রেস্তরাঁয় আউটডোর সার্ভিস নিষিদ্ধ করে, তখন স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটিগুলো তাদের নিজেদের মতো স্বাস্থ্য বিভাগ পরিচালনার জন্য ভোট দেয়।
আরো বিব্রতকর বিষয় হলো ‘মেডিকেল ফ্রিডম’ আন্দোলন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। তাদের পক্ষে রয়েছেন ট্রাম্প। আর তার সমর্থকরা তাকে অনুসরণ করছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোনো প্রমাণ ছাড়াই দাবি করছেন এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট চুরি করা হয়েছে এবং এই নির্বাচনকে বাতিল করতে হবে। তার অভিযোগ, নির্বাচনের সময় যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভট ভোটিং মেশিনে হানা দেয়া হয়েছে। এ থেকে এখন স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে আমি বিজয়ী। বিষয়টি তার কাছে এবং তার গোঁড়া সমর্থকদের কাছে স্পষ্ট হতে পারে, যারা ‘স্টপ দ্য স্টিল’ প্রতিবাদ করছেন এবং সরকারি কর্মকর্তাদের হুমকি দিচ্ছেন।
ট্রাম্প সমর্থকরা ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এনে ভুল তথ্য প্রচার করছেন। ভোট জালিয়াতি রুখতে ট্রাম্পের আইনি টিমের সদস্য অ্যাটর্নি জেনারেল সিডনি পাওয়েল। তিনি পরিসংখ্যানগত তথ্যপ্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে, ভোট গ্রহণের মেশিনগুলোতে ব্যালট পরিবর্তন করা হয়েছে। আর এই কাজ করে থাকতে পারে ভেনিজুয়েলা, কিউবা এবং চীন।
অন্যদিকে ‘মেডিকেল ফ্রিডম’ কর্মীরা কোভিড-১৯ এর টিকার বিষয়ে ভুল তথ্য প্রচার করছে। তাদের মতে এই টিকার মাধ্যমে রোগীদের শরীরে মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকার নাগরিকদের বিরুদ্ধে নজরদারি করবে। এ ছাড়া এই টিকা দিয়ে নারীদের বন্ধ্যা করে দেয়া হচ্ছে বলে তারা প্রচারণা চালাচ্ছে। আর এই টিকার মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন বিলিয়নিয়ার বিল গেটস। নির্বাচন নিয়ে যেমন অনলাইনে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়েছে, এর পরপরই টিকা নিয়েও একই কাজ করা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প করোনা মহামারির সংকটকে ছোট করে দেখার চেষ্টা করেছেন। কারণ এটি তার নির্বাচনী এজেন্ডায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছিলো। তিনি যদি করোনা মহামারিকে একটি সংকট হিসেবে দেখতে অস্বীকৃতি জানান, হয়তো এটাকে সংকট হিসেবে দেখা হবে না। একজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, তিনি করোনাভাইরাসের বিষয়টিকে সময়ের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ নিয়ে তার কাজ শেষ হয়ে গেছে। তিনি এ খাতে যে সময় দিয়েছেন তা প্রয়োজনের বেশি। একজন টিকার প্রশিক্ষক বলেন, ট্রাম্প হলেন একজন সেলসম্যান। কিন্তু এটা এমন একটি ইস্যু, যা তিনি বিক্রি করতে পারেন না। তাই তিনি বিষয়টি ত্যাগ করেছেন।
ট্রাম্প কখনো নিজেকে পরাজিত দেখতে চান না। এ জন্যই সারা বছর তিনি মহামারির বিষয়ে এত কম মনোযোগ দিয়েছেন। এর ফল হিসেবে তিনি চিহ্নিত হয়েছেন একজন বড় পরাজিত হিসেবে। নির্বাচনে তিনি হেরে গেছেন।
(অনলাইন দ্য হিল থেকে অনুবাদ)