অভিজাত এলাকার পিঠার দোকানগুলোতে জমে ওঠে বিক্রি প্রতি বছর শীত মৌসুম আসতে না আসতেই ফুটপাথ থেকে শুরু করে । আর সারা বছর এই শীত মৌসুমের অপেক্ষায় থাকেন পিঠা ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এ বছর চিত্র ভিন্ন। ফুটপাথগুলোতে পিঠার দোকান খুব একটা চোখে পড়ছে না। বেইলী রোড, গুলশান, বারিধারার পিঠার দোকানগুলোতেও নেই কোনো ভিড়-ভাট্টা। নেই কোনো পিকনিক বা পিঠা উৎসবের আয়োজন। বিয়ে-শাদি হলেও তা হচ্ছে সীমিত পরিসরে। থাকছে না গায়ে হলুদের তেমন কোনো আয়োজন।
করোনার করুণ গ্রাসে পিঠা ব্যবসায় চলছে মন্দা। ২০ বছর ধরে ফুটপাথে পিঠা বিক্রি করেন শিল্পী বেগম। বয়স পঞ্চাশ। পিঠা বিক্রি করেই চলতো সংসার। তেলের পিঠা, চিতই পিঠা আর সঙ্গে ১৪ রকমের ভর্তার পসরা সাজিয়ে বসেন ফার্মগেটের হলিক্রস কলেজের উল্টো পাশের ফুটপাথে। প্রতিটি তেলের পিঠা আর চিতই পিঠার দাম পাঁচ টাকা। করোনার শুরুতে বাড়িতে চলে গেলেও দু’মাস ধরে ঢাকায় এসেছেন তিনি। অল্প পরিসরে পিঠার পসরা সাজিয়ে বসলেও পিঠার ক্রেতার অভাব। বেচা-বিক্রি নেই বললেই চলে। দুই কেজি চালের পিঠা বানালেও বিক্রি হচ্ছে না। শিল্পী বেগম বলেন, দেহেন কোনো মানুষ আসে না পিঠা খাইতে। আশপাশের কিছু দোকানদার ছাড়া কেউ পিঠা কিনে না। আগে ১০ কেজি চালের গুঁড়ি গুলাইয়া পিঠা তৈরি কইরাও কুলাইতে পারতাম না। আর এখন দুই কেজি চালের গুঁড়ির পিঠাও বিক্রি হয় না। হইবো কেমনে স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। শীতের সময় স্কুলের বাচ্চারা বেশি পিঠা খাইতো। বাচ্চার মায়েরা চিতই পিঠা কিনে নিয়ে বাসায় দুধে ভিজাই তো। স্কুলে কত গাড়ি আসতো এই ড্রাইভাররা খাইতো। আগে আরো কত বেশি রিকশাওয়ালা ছিল তারা খাইতো। এখন তো মানুষের ভিড়ই নাই। আর করোনার ভয়ে মানুষ তো বাইরের জিনিস খায় না। করোনা শুরুর পর ফরিদপুর চইলা গেছিলাম। ৮ মাস পর দেশ থাইকা বড় আশা নিয়া ঢাকা আসছিলাম যে, পিঠার ব্যবসা আবার শুরু করবো। কিন্তু পিঠাই তো বিক্রি হয় না। খুব কষ্টে আছি। আমরা গরিব মানুষ দিন আনি দিন খাই। এখন সারা মাস পিঠা বিক্রি কইরা ঘর ভাড়া ওঠে না। খামু কি আর ঘর ভাড়াই দিমু কি? করোনা আমাদের শেষ কইরা দিলো।
ফেরদৌস কোরাইশী ফুটপাথে ভাঁপা পিঠা বিক্রি করেন। ফেরদৌস বলেন, এইবার শীতে মানুষ পিঠা খায় না। মানুষ এখন ভয় পায়। মুখে মাস্ক পইরা থাকে। পিঠা খাইলে তো মাস্ক খুলতে হইবো। মাস্কও খুলে না পিঠাও খায় না। শীতে সবচেয়ে বেশি চলতো ভাপা পিঠা। গত বছরও সকাল থেইকা রাত পর্যন্ত পিঠা বানাইছি। আর এখন আসরের আজান পড়লে আইসা বসি ৮-৯ টার দিকে চইলা যাই। পঞ্চাশটা পিঠাও বিক্রি হয় না। আগে শীতের সময় প্রতিদিন তিন-চারশো পিঠা বিক্রি হইতো। আবার গায়ে হলুদ পিকনিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের ভাড়া কইরা নিয়া যাইতো পিঠা বানাইতে। এতে অনেক লাভ হইতো। এখন তো অনুষ্ঠান বন্ধ। আমাদের সঙ্গে আরো যারা পিঠা বানাই তো তারা বেশির ভাগই করোনা সময় দেশে গিয়া আর আসে নাই। আমিও ফরিদপুর চইলা গেছিলাম। দেশেও কাম-কাজ নাই। আর কতদিন বইসা থাকুম। এই জন্য গত মাসে ঢাকা আসছি। ধার-কর্য কইরা অনেক কষ্টে আবার পিঠার দোকান চালু করছি। মনে করছি পিঠা বিক্রি কইরা ধার শোধ হইবো আবার কিছু লাভও হইবো। কিন্তু পিঠাই তো বিক্রি হয় না। এখন তো করোনা আরো বাড়তেছে সামনে মনে হয় দোকানই বন্ধ কইরা আবার দেশে চইলা যাইতে হইবো।
এদিকে বেইলি রোড, গুলশান, বারিধারায় তিনটি আউটলেট রয়েছে পিঠাঘরের। সবগুলো আউটলেটে বিক্রি নেমে এসেছে অর্র্ধেকের নিচে। পিঠাঘরের জেনারেল ম্যানেজার আকতারুজ্জামান বলেন, পিঠার ব্যবসা খুব খারাপ। মূলত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি এই তিন মাস পিঠার ব্যবসার মূল সময়। যদিও আমাদের সারা বছর পিঠাঘরে পিঠা পাওয়া যায়। কিন্তু এই তিন মাসে আমরা যা আয় করি তা দিয়ে সারা বছর দোকানের খরচ চলে যায়। এ বছর নভেম্বর চলে গেল ডিসেম্বর মাসও চলছে কিন্তু পিঠার কোনো বড় অর্ডার পাইনি। অথচ আগে শীত মৌসুমে অনেক অর্ডার ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এবং কর্পোরেট হাউজগুলো আমাদের গ্রাহক। করোনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত আমাদের ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা লস দিতে হয়েছে। আমাদের কর্মচারীর ৮০ ভাগই নেই। ২০ ভাগ দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের দোকান বন্ধ করে দিতে হবে। শীত মৌসুম ছাড়া পহেলা বৈশাখে আমাদের বড় বড় অর্ডার থাকে। এ বছর তো পহেলা বৈশাখেও কোনো অর্ডার ছিল না। আর সরকার থেকেও তো কোনো বড় অনুষ্ঠান করতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ কারণে এবার শীতে ভালো কোনো অর্ডার আসবে বলে মনে হয় না।