এ এক কঠিন প্রশ্ন কোভিড অতিমারী বা প্যান্ডেমিকের শেষ কোথায়। এর উত্তর কারোই জানা নেই। আমরা মেডিকেল কলেজে রোগতত্ববিদ্যায় যেমনটা পড়েছি যে সংক্রামক ব্যাধিতে ভেক্টর বা জীবাণু, হোস্ট বা সম্ভাব্য রোগাক্রান্ত ব্যাক্তি এবং এনভায়রনমেন্ট অর্থাৎ পরিবেশ এই তিনটি মিলে একটি ত্রিভুজ তৈরী করে। এই তিন বিষয়ের ভারসাম্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে ঐ প্রশ্নের উত্তর।
কোভিড প্যান্ডেমিক তখনই শেষ হবে যখন এই ভাইরাসটি সংক্রমণ করার মতো যথেষ্ট সংখ্যক ইমিউনিটিবিহীন মানুষ আশেপাশে সহজে খুঁজে পাবে না। এ বিষয়টি কয়েকভাবে হতে পারে। মিউটেশনের কারণে অথবা ক্রমাগত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে ভাইরাসটি এক সময়ে সংক্রমণ ঘটানো বা ক্ষতি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। যেমনটি ঘটেছে কোভিডের বড় ভাই ২০০২-৩ সালের প্রলয়ংকারী সার্স ভাইরাস-১ এর ক্ষেত্রে। আবার ক্রমাগত সংক্রমণ এবং ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে ইমিউনিটি তৈরী হওয়ার কারণে রোগ সংক্রমণ চক্র ভেঙ্গে যেতে পারে ( হার্ড ইমিউনিটি)।
এছাড়া অন্তত তত্ত্বগতভাবে পরিবেশের কোন বড় ধরনের পরিবর্তনের ফলেও প্যান্ডেমিক থেমে যেতে পারে।
একটি বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে কোভিডের বিলুপ্তি আর কোভিড প্যান্ডেমিকের সমাপ্তি কিন্ত এক বিষয় নয়। অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক সংক্রমণ বন্ধ হলেই প্যান্ডেমিকের সমাপ্তি ঘটবে। স্মলপক্স বা গুটি বসন্তের মতো কোভিডের বিলুপ্তি ঘটানো সহজ হবে না। কোভিড হয়তো থেকে যাবে, কিন্ত তখন এটি প্যান্ডেমিক থেকে প্রথমে এপিডেমিক এবং পরে এক পর্যায়ে হয়তো অঞ্চল বিশেষে এন্ডেমিকে পরিণত হবে। তখন বিশ্বের সেই সব অঞ্চলে যেতে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন যেমন আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকার কিছু অঞ্চলে যেতে হলে ইয়েলো ফিভার ভ্যাক্সিন নিতে হয়।
এর চেয়েও কঠিন প্রশ্ন হল প্যান্ডেমিকের শেষ কবে? এর উত্তর কারো জানা নেই। শুধু এটুকু বলা যায় যে সব কিছু ঠিক মতো চললে ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে উন্নত ও ধনী রাষ্ট্রগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভ্যাক্সিন দেয়া সম্পন্ন হবে। আশা করা যায় সে সময়ে এ দেশগুলোতে কোভিডের লাগামহীন সামাজিক সংক্রমণ মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আসবে। বাংলাদেশ সহ তৃতীয় বিশ্বে হয়তো সময় আরেকটু বেশি লাগবে। ভ্যাক্সিন পর্বের অগ্রগতি, ভ্যাক্সিনের প্রকৃত কার্যকারিতা, মাস্কের সার্বজনীন ব্যবহার, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখাসহ কোভিড প্রতিরোধী অভ্যাসযুক্ত লাইফস্টাইল গ্রহনের প্রবণতা এ সব কিছুর উপর নির্ভর করবে কোভিড মহামারীর চূড়ান্ত গতিপ্রকৃতি। কোভিড সংক্রান্ত বিধি নিষেধ থেকে খুব দ্রুত নিস্তার পাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কাজেই এসব বিধি নিষেধকে বিরক্তিকর ঝামেলা না ভেবে এগুলোকে জীবনরক্ষাকারী লাইফস্টাইলের অংশ হিসেবে বরণ করে নেয়াই হবে বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। প্রতিদিন লাখলাখ মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছেন, অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন বা স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই তাই বিশ্বের সাতশো কোটি মানুষকে নিজের জীবন বাঁচানোর এ যুদ্ধ লড়তে হচ্ছে। কোভিডের বিরুদ্ধে জীবন বাঁচানোর এ লড়াই আরো বেশ কিছুদিন চলবেই। মহান আল্লাহ আমাদের সকল বিপদ থেকে রক্ষা করুন।
[লেখক: বিভাগীয় প্রধান, কার্ডিয়াক সার্জারী বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল]