স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ কারও কাছেই সে পরিসংখ্যান নেই দেশে প্রতিদিন কতজনের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ছে। ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়ে হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ যেসব জায়গায় এনএস-১ এন্টিজেন টেস্ট করা হয় সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করার কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। ফলে প্রকৃত রোগীর সংখ্যা বরাবরই অজানা থাকছে। শুধুমাত্র যেসব রোগী বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নেওয়ার পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এসে ভর্তি হচ্ছে তাদের সংখ্যা ধরেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের হিসাব প্রকাশ করা হচ্ছে। আর এ হিসাবে চলতি আগস্ট মাসের শুরুতেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ঘণ্টায় ১০০ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পহেলা আগস্ট ঢাকার ১ হাজার ১৩১ জনসহ মোট ২ হাজার ৫৮৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ২ আগস্ট ঢাকার ১ হাজার ১৩০ জনসহ ২ হাজার ৭১১ জন, ৩ আগস্ট ঢাকার ১ হাজার ১০১ জনসহ ২ হাজার ৫৮৯ জন এবং ৪ আগস্ট ঢাকার ৪৯২ জনসহ ১ হাজার ৭৫৭ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। অর্থাৎ চার দিনে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ৬৪১ জন। এ হিসাবে প্রতি ঘণ্টায় একশ’ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে।

অথচ গত জুলাই মাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ৬০ জনেরও কম মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এ হিসাবে গত মাসের তুলনায় আগস্টে প্রতি ঘণ্টায় আক্রান্তের হার ৪০ শতাংশেরও বেশি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর বিভিন্ন মডেল সার্ভে করে কীটতত্ত্ববিদরা আগস্টে আক্রান্ত-ও মৃতের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বাড়তে পারে বলে আগে সতর্ক করেছিলেন। অথচ এরপরও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোনো বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। অথচ র‌্যাপিড অ্যাকশন ছাড়া এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অসম্ভব। আগস্ট মাসজুড়ে ডেঙ্গু ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ভয়াবহ তাণ্ডব চালাতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, ঢাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন জেলা শহর, উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলে যেভাবে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে তাতে মৃত্যুর মিছিল দ্রুত দীর্ঘ হবে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা। তারা জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর রক্তের প্লাটিলেট অস্বাভাবিকভাবে কমে গেলে দ্রুত প্লাটিলেট দিতে হয়। তবে দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অনেক হাসপাতালেই রক্ত থেকে প্লাটিলেট আলাদা করার মেশিন নেই। ডেঙ্গুর শক সিনড্রোমে আইসিইউ জরুরি হলেও সেখানে এ সংকট তীব্র। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে উন্নত স্বাস্থ্য সেবা পরিকাঠামো গড়ে উঠেনি। তাই সেখানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লে মৃত্যুর হারও বৃদ্ধি পাবে।

চলতি মাসের প্রথম চার দিনের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে মোট ৫ হাজার ৩৮৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এ সময় ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ২৫৪ জন। যদিও এ সময় ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরে মৃতের সংখ্যা অনেক কম বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখা পরিসংখ্যান দিয়েছে।

তবে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল ও ঢাকা মেডিকেলসহ সাতটি সরকারি হাসপাতাল এবং প্রায় এক ডজন বেসরকারি হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ঢাকার বাইরে থেকে গুরুতর অসুস্থ বিপুলসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছে। শারীরিক নানা জটিলতা নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় আসায় তাদের অনেককে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। এসব মৃত রোগীকে ঢাকার মৃত্যু তালিকায় যুক্ত করা হচ্ছে। যে কারণে ঢাকার বাইরে প্রকৃত মৃত্যুর চিত্র মিলছে না।

ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বাড়ায় আরও ভিন্ন কারণে আগামীতে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, এতদিন রোগীর সংখ্যা রাজধানীতে বেশি ছিল। এখন গ্রামেও বাড়ছে। শহরে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খুব একটা সাজানো না থাকলেও এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু গ্রামে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জরুরি ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে। এমন বাস্তবতায় সামনের দিনগুলোয় অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে আরও বলেন, ঢাকার বাইরের এলাকাগুলো ভাইরাসের জন্য অবারিত ক্ষেত্রে পরিণত হয়ে উঠছে। এতে শঙ্কার দিক হলো, পরের বছর ঢাকার বাইরে আরও রোগী বাড়বে। এবার ডেঙ্গুর যে ধরনে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন পরের বছর অন্য ধরন দিয়ে আক্রান্ত হবেন। ঢাকার বাইরে তখন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়বে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, পরিস্থিতি যথেষ্ট আশঙ্কাজনক। যে হারে রোগী বাড়ছে তাতে হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ বাড়বে। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। রোগী বাড়লে মৃত্যুও বাড়তে পারে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সম্মিলিত তৎপরতা জরুরি বলে মত দেন তিনি।

এদিকে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে ইচ্ছে মাফিক ডেঙ্গু চিকিৎসার খরচ আদায়ের বিষয়টি কঠোর নজরদারির পাশাপাশি ‘গলাকাটা ফি’ আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য, এ ব্যাপারে লাগাম টানা না গেলে বিনা চিকিৎসা কিংবা অদক্ষ চিকিৎসার কারণে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার বাড়বে। নিম্নবৃত্ত মানুষ সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ না পেলে বাসাবাড়িতে ধুঁকে ধুঁকে মরবে।

তাদের এ আশঙ্কা যে অমূলক নয় তা ডেঙ্গু আক্রান্ত স্বল্প আয়ের একাধিক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সবুজবাগের মান্ডার বাসিন্দা সিএনজি অটোরিকশা চালক মিরাজুল ইসলাম জানান, তার দুই সন্তানের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ায় তাদের মুগদা হাসপাতালে নিয়ে যান। তবে তাদের শারীরিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো আছে জানিয়ে চিকিৎসকরা তাকে বাসায় চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন। রক্তে প্লাটিলেট ৫০ হাজারের নিচে নামলে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। ক’দিন পর তার এক সন্তানের রক্তের প্লাটিলেট ৪০ হাজারের নিচে নামলেও শয্যা সংকটে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করতে পারেননি। এ অবস্থায় স্থানীয় একটি ক্লিনিকে চার দিন রেখে গুরুতর অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসা করান। এতে তার পরিবারের পুরো সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে। তাই আরেক সন্তানের অবস্থা পরবর্তীতে খারাপ হলেও তাতে আর বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারেননি। ঝুঁকি নিয়ে তাকে বাসায় রেখেই চিকিৎসা করতে হয়েছে।

একই ধরনের অভিযোগ করেছেন মেরাদিয়ার বাসিন্দা জান্নাতুল ফেরদৌসী। গৃহপরিচারিকার কাজ করে সংসার চালানো এই বিধবা নারী জানান, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে না পেরে ডেঙ্গু আক্রান্ত মেয়েকে বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। এক সপ্তাহে তার পেছনে সারা জীবনের সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে। আর দু-একদিন হাসপাতালে থাকতে হলে মেয়ের চিকিৎসা করানো তার পক্ষে সম্ভব হতো না বলে জানান ফেরদৌসী। তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারি হাসপাতালে যেখানে নিজস্ব দাতার কাছ থেকে এক ব্যাগ প্লাটিলেট নিতে খরচ হয় ২ হাজার টাকার মতো, সেখানে বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। শুধু নিজেদের বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজন না হলেও অনেক রোগীকে প্লাটিলেট দেওয়া হচ্ছে। অপ্রয়োজনে প্লাটিলেট নেওয়ার ফলে রোগীর শরীরে নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার আশরাফুল হক বলেন, ডেঙ্গু হলেই প্লাটিলেট লাগবে-এমন একটি ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে জন্মেছে। এই ধারণাকে পুঁজি করে বেসরকারি হাসপাতালগুলো যেসব রোগীর প্লাটিলেট প্রয়োজন না, তাদেরও প্লাটিলেট দিচ্ছে। প্লাটিলেটের অযাচিত ব্যবহারে রোগীর ঝুঁকি আরও বাড়ছে।

চিকিৎসকরা জানান, র‌্যান্ডম ডোনার প্লাটিলেট প্রক্রিয়ায় চারজন দাতার রক্ত নিয়ে এক ব্যাগ প্লাটিলেট তৈরি করা হয়। সরকারি হাসপাতালে এই প্রক্রিয়ায় প্লাটিলেট পেতে শুধু স্ক্রিনিং ও ক্রস ম্যাচিং ফি দিতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে রক্তের ব্যাগ না থাকলে সেই দামটি ফির সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু বেসরকারিতে চার দাতার রক্ত পরিসঞ্চালনেই রোগীর ব্যয় হয় প্রায় ৬ হাজার টাকা। এর সঙ্গে যোগ হয় ডোনার স্ক্রিনিং ও ক্রস ম্যাচিং ফি। আর প্রতি ব্যাগ রক্ত থেকে প্লাটিলেট বের করতে দিতে হয় সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ চার ব্যাগ রক্ত থেকে এক ব্যাগ প্লাটিলেট পেতে রোগীর ব্যয় হয় ১৪ থেকে ২০ হাজার টাকা। আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসেবে আরও দিতে হয় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। ডেঙ্গু রোগীদের প্লাজমার ক্ষেত্রেও একই ব্যয় হচ্ছে।

এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর পকেট কাটতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর নানা ফাঁদ তৈরিরও ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, রোগীদের চিকিৎসার ব্যয় বাড়াতে বেসরকারি হাসপাতালে প্রথম থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে। এ ছাড়া অপ্রয়োজনে অ্যালবুমিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। এতে রোগীর চিকিৎসার ব্যয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া নিম্নমানের অ্যালবুমিন ব্যবহারে রোগীর শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। এমনকি এতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031