র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে । এদের মধ্যে তিন নারীও রয়েছে। সোমবার রাতে রাজধানীর কাউলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলো- শরিয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর গ্রামের ইমাম হোসেনের মেয়ে ফাতেমা ইমাম তানিয়া (২৬), চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার গাছুয়া গ্রামের আশরাফ উল্লাহর মেয়ে আফসানা মিমি (২৩), মানিকগঞ্জ সদরের সরুপাই গ্রামের সালাম মিয়ার মেয়ে সালমা সুলতানা (২৬), বগুড়া সদরের জহুরনগর গ্রামের তফাজ্জল শেখের ছেলে শেখ মোহাম্মদ বাঁধন ওরফে পারভেজ (২৮) এবং শরিয়তপুর জেলার সখীপুরের চরভাগা গ্রামের মো. নাছিরের ছেলে রুহুল আমিন ওরফে সায়মন। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ১৯৭০টি ইয়াবা, বিদেশি মুদ্রা ও পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। গতকাল কাওরান বাজারের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন সংস্থাটির মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।

তিনি বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের সঙ্গে জড়িত। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে।

এ চক্রের নেতৃত্বে আছে আরিফ ও রেহেনা নামে দুই বাংলাদেশি। আফগানিস্তান থেকে মাদক সরবরাহ করে কয়েকটি দেশ ঘুরে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে তা শ্রীলঙ্কায় পাচার করে আসছে। তিনি বলেন, গত বছরের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে বিশেষ অভিযানে ২৭২ কেজি হেরোইন ও ৫ কেজি কোকেনসহ মো. জামাল উদ্দিন ও রাফিউল ইসলাম নামে দুই বাংলাদেশি গ্রেপ্তার হয়। তার কয়েকদিন পর ৩২ কেজি হেরোইনসহ বাংলাদেশি নাগরিক সূর্যমণি গ্রেপ্তার হয়। ১ মাসের মধ্যে হেরোইন ও কোকেনসহ বাংলাদেশি গ্রেপ্তারের ঘটনাটি তদন্তে বাংলাদেশে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।

টাস্কফোর্সের অভিযানে গত ১২ই জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে চয়েজ রহমান নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করা হয়। সেই মামলার ছায়া তদন্তে নামে র‌্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার রাজধানীর বিমানবন্দরের পাশে কাউলা এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে ৫ জনকে  গ্রেপ্তার করা হয়। মুফতি মাহমুদ খান বলেন, স্মার্ট সুন্দরী তরুণীদের প্রলোভনে ফেলে তাদের দিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রীলঙ্কায় মাদক পাচার করতো আন্তর্জাতিক মাদক পাচারচক্র। তিনি বলেন, এরা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে খালি হাতে যেত, এরপর ওই দেশ থেকে লাগেজে করে মাদক নিয়ে যেত শ্রীলঙ্কায়।

মুফতি বলেন, মাদক পাচারে কয়েকটি রুটের তথ্য আমরা পেয়েছি। এগুলো সাধারণত আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান হয়ে শ্রীলঙ্কা এবং আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান ও মালয়েশিয়া হয়ে শ্রীলঙ্কায় যেত। এ ছাড়াও মালয়েশিয়া থেকে চীন হয়ে শ্রীলঙ্কা রুটের কথাও জানা  গেছে। এ আন্তর্জাতিক চক্রে একটি বাংলাদেশি গ্রুপ সক্রিয়। যার নেতৃত্বে আরিফ ও রেহানা নামে দুই ব্যক্তির কথা জানা গেছে। রেহানা মাদকসহ চীনে গ্রেপ্তার হয়ে সেখানকার কারাগারে আছে। আরিফ কোনো এক দেশে আত্মগোপন করে রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তিনি বলেন, মাদকগুলো আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে অন্যান্য দেশ ঘুরে শ্রীলঙ্কা গেলেও রুট হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহূত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশিদের এই গ্রুপটি দেশের অভ্যন্তরে ইয়াবা পাচার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। তাদের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমের বিষয়টিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে মুফতি বলেন, আটক ৫ জনের মধ্যে ৪ জনই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে মাদক চালানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে তানিয়া নিজ এলাকা শরীয়তপুরে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তিনি অনলাইন ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। ২০১৬ সালে রাজধানীর তাজমহল রোডে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কোচিং করার সময় ফারহানা ও রুহুল আমিনের মাধ্যমে রেহানার সঙ্গে পরিচয় হয় তানিয়ার।

রেহানা হলেন ফারহানার বড় বোন। বিদেশে অল্পদিনের ভ্রমণেই লাখ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব এমন প্রলোভনে আন্তর্জাতিক মাদক পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তানিয়া। সে ওই বছর রেহানার সঙ্গে মালয়েশিয়া গিয়ে ১০ দিন থাকে। সেখান থেকে শ্রীলঙ্কা গিয়ে ৩-৪ দিন অবস্থান করে বাংলাদেশে ফেরত আসে। এরপর ২০১৭ সালে আরিফের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে ২ বার ভারত, ৩ বার চীন এবং ৮-১০ বার মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেছে। র‌্যাবের দাবি, চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার সময় খালি হাতে যায় এবং অন্য দেশে গিয়ে লাগেজসহ মাদক বহন করে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার কাজ করে। এ ছাড়াও অন্য রুটে আসা মাদকও তারা সংগ্রহ করে তা বণ্টনের কাজ করতো। এক্ষেত্রে তারা মাদকের শুধু বাহক হিসেবেই নয়, চক্রের সক্রিয় সদস্য হিসেবে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতো বলেও জানান মুফতি মাহমুদ খান।

মুফতি বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া আফসানা মিমি বিভিন্ন জায়গায় ডিজে নাচ ও গান করতো। একটি বেসরকারি  টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করতে গিয়ে সায়মনের সঙ্গে তার পরিচয়। এরপর সায়মনের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক মাদক পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে মিমি। শ্রীলঙ্কার যে বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকসহ বাংলাদেশি নাগরিক সূর্যমণিকে আটক করা হয়, সে বাড়িটি মিমির নামেই ভাড়া নেয়া হয়েছিল। সেই বাসাটি সাধারণত সিন্ডিকেটের সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মাদক বিস্কুট ও কেকের প্যাকেটে করে সাপ্লাই করা হতো। মিমি ২০১৭ সালে আরিফের সঙ্গে প্রথম মালয়েশিয়া যান এবং সেখান থেকে শ্রীলঙ্কা যান।

২০১৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো শ্রীলঙ্কা গেলে আরিফ তাকে সূর্যমণির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। র‌্যাব বলছে, আটক সালমা সুলতানা ২০১০ সালে এইচএসসি পাস করে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ শুরু করে। এ সময় তানিয়ার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে রেহানার সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সে। বেশ কয়েকবার ভারত, চীন ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেছে। এ ছাড়া আটক সায়মন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কাজ করে। সে সুবাদে মেয়েদেরকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে চক্রে জড়িয়ে ফেলতো  সে। আটক পারভেজের কর্মসূত্রে আরিফের সঙ্গে পরিচয় হয়। ২০১৮ সালে দুইবার শ্রীলঙ্কায় গিয়ে সে প্রায় ১ মাস অবস্থান করে। সে সময় মাদকদ্রব্য সংগ্রহ, প্যাকেজিং ও সরবরাহে জড়িত ছিল  সে। এ চক্রের সঙ্গে জড়িত  দেশি-বিদেশি আরো বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া  গেছে। তদন্তের অগ্রগতি সাপেক্ষে পরবর্তীতে  বিস্তারিত জানানো সম্ভব হবে বলেও জানান মুফতি মাহমুদ খান

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031