সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে । হাই কোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মো. সাব্বির ফয়েজ গতকাল মঙ্গলবার সকালে বলেন, ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায় প্রকাশ হয়েছে।পূর্ণাঙ্গ রায় ওয়েবসাইটেও দেওয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত।

সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবীর এক রিট আবেদনে হাই কোর্ট ২০১৬ সালে সংবিধানের ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে। গত ৩ জুলাই আপিল বিভাগেও ওই রায় বহাল থাকে, যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি গতকাল প্রকাশ করা হলো। সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায়ের ফলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা আবারও জাতীয় সংসদ থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে যাচ্ছে। খবর বিডিনিউজের।

বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই রাখা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর আমলে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের পর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধন এনে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন।

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী। প্রাথমিক শুনানির পর হাই কোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল দেয়। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। ২০১৬ সালের ৫ মে হাই কোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয় ওই বছরের ১১ আগস্ট।

তিন বিচারকের ওই বেঞ্চের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজাউল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। অন্য বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল তাতে ভিন্নমত জানিয়ে আলাদা রায় দেন।

হাই কোর্টের রায় : ‘বলতে দ্বিধা নেই, ষোড়শ সংশোধনী একটি কালারেবল লেজিসলেশন (কোনো কাজ সংবিধানের মধ্যে থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইনসভা যখন ছদ্ম আবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরি করে), যা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন। এটা সংবিধানের দুটি মূল কাঠামো ৯৪()ও ১৪৭() অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন। একইসঙ্গে সংবিধানের ৭(বি) অনুচ্ছেদকেও আঘাত করে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে রুল যথাযথ (অ্যাবসলিউট) ঘোষণা করা হলো। ষোড়শ সংশোধনী আইন ২০১৪ কালারেবল, এটি বাতিল এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হলো।’

হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে চলতি বছর ৮ মে আপিল বিভাগের ‘ফুলবেঞ্চে’ শুনানি শুরু হয়। সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্র ?ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরা। গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির শুনানিতে আপিল বিভাগ আদালতবন্ধু হিসেবে ১০ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর বক্তব্য শোনেন। তাদের মধ্যে কামাল হোসেনসহ নয়জনই সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে অর্থাৎ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেন।

কামাল হোসেনের সঙ্গে একই মত পোষণকারীরা হলেন টি এইচ খান, এ এফ এম হাসান আরিফ, এম আমীর উল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী, এম আই ফারুকী ও আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া। অন্যদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের পক্ষে অবস্থান জানান শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি। আদালত মোট ১২ জন আইনজীবীকে অ্যামিচি কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিলেও তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার রফিকউল হক ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মতামত দেননি। তাদের বাইরে ‘ইন্টারভেনার’ হিসেবে সংবিধানের এই সংশোধনের পক্ষে যুক্তি দেখান সাবেক আইনমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু।

শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের আপিল বিভাগ ৩ জুলাই যে রায় দেয়, তাতে হাই কোর্টের রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্জ (বাদ দিয়ে) করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ‘সর্বসম্মতভাবে’ খারিজ করে দেওয়া হয়।

পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ে প্রতিক্রিয়া : আইনমন্ত্রী

বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ার পর এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। আইনমন্ত্রী বলেন, আমি শুনেছি, সুপ্রিম কোর্ট পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে। কিন্তু আমি রায়টি এখনো পড়িনি। পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ার পর আমি আমার প্রতিক্রিয়া জানাব।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পাকিস্তান ও জিয়ার কনসেপ্ট’

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কনসেপ্টটি হলো সেনাশাসক, পাকিস্তানের ও জিয়াউর রহমানের। কাজেই এটি পুনঃস্থাপনে আমি ব্যথিত। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, সার্বিক কমেন্টস করতে হলে পুরো রায়টা পড়ে কমেন্টস করতে হবে। তবে আমার একটি দুঃখ রয়ে গেছে। সেই দুঃখ হলো সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদটি সংযুক্ত হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে। টোটাল বিষয়টি দাঁড়ালো যে, মার্শাল আমলে সংবিধানের ৯৬ ধারা সংশোধন করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধন করা হয়েছিল সেটিকে পুনঃস্থাপন করা হলো।

 

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031