পদ্মা সেতুর ল্যাম্পপোস্টের আলো যে দ্যুতি ছড়িয়েছে, তা বাংলাদেশের অগ্রগতি ও অগ্রযাত্রার নিদর্শন বলা যায়। গত ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে দেশের ১৭ কোটি মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে যেমন নতুন মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন তেমনি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেলও আজ স্বপ্ন নয়, বরং বাংলাদেশের সক্ষমতার আরেক নিদর্শন বা প্রতীক হিসেবে কাজ করবে। চট্টগ্রাম তথা দেশের জনগণ প্রহর গুণছে স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল পাড়ি দেওয়ার।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর চট্টগ্রাম তথা দেশবাসীর কাছে এখন আরেক আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন অবিরত সেই স্বপ্নের টানেল উদ্বোধনের অপেক্ষার প্রহরের উচ্ছ্বাস-আনন্দের বার্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বলতে গেলে, দেশের কোটি কোটি মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর এবার দেশের আরেক মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধনের প্রহর গুণছে দেশবাসী।

আগামী ডিসেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেলের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন দেশের ১৭ কোটি মানুষের মর্যাদার প্রতীক কর্ণফুলীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম বঙ্গবন্ধু টানেল।

বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ বলেন, গত মে মাস পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ। এখন টানেলের ভেতরে ইন্টারনাল স্ট্রাকচারের কাজ চলছে। টানেলের দুটি টিউবের খনন কাজ আগেই শেষ হয়েছে। দুই টিউবের ক্রস প্যাসেজের কাজ চলছে। উচ্চমাত্রার ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কথা চিন্তা করেই টানেলের ডিজাইন করা হয়েছে। টানেলের মুখে ফ্লাডগেটসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ডিজাইন অনুযায়ী। সুতরাং জলোচ্ছ্বাস হলেও টানেলের কোন ক্ষতি সাধন হবে না।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের অবশিষ্ট ১৪ শতাংশ কাজ শেষ হলেই বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ আরেক নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চট্টগ্রামসহ দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘুরে যাবে দ্রুত বেগে। বাড়বে জীবনযাত্রার মান ও কর্মসংস্থান। কর্ণফুলী নদীর আনোয়ারা অংশে অর্থাৎ দক্ষিণ চট্টগ্রামে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণে আসবে বিদেশি বিনিয়োগ।
এদিকে কর্ণফুলীর দক্ষিণে আনোয়ারায় রয়েছে কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইপিজেড, সিইউএফএল, পারকি সমুদ্র সৈকত। কর্ণফুলী পেরিয়ে আনোয়ারা হয়ে কক্সবাজার, বাঁশখালী ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের সাথে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। চীনের সাংহাই সিটির আদলে চট্টগ্রাম শহর ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলে রূপ পাবে। কর্ণফুলীর দক্ষিণ ও পূর্ব তীরবর্তী পশ্চিম পটিয়া ও আনোয়ারা পরিণত হবে উপশহরে।

কর্ণফুলীর অপর প্রান্তে সিইউএফএল এলাকায় টানেলের মুখ থেকে শুরু হয়ে কালাবিবিরদীঘি পর্যন্ত গিয়ে পিএবি সড়কের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে টানেল রোড। অন্যদিকে শিকলবাহা ওয়াই জংশন থেকে সাড়ে ১১ কিলোমিটার ছয় লেনের সড়ক তৈরি করা হচ্ছে। এটিও কালাবিবিরদীঘি পর্যন্ত গিয়ে যুক্ত হবে টানেল রোডের সঙ্গে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও চীন সরকারের (জি টু জি) যৌথ অর্থায়নে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা আর চীন সরকারের ঋণ পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধনের পর টানেলের চট্টগ্রাম নগরের প্রান্তের কাজ শুরু হয় পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির পাশ থেকে। এটি কাফকো ও সিইউএফএল সীমানার মাঝখান দিয়ে উঠে কর্ণফুলী-আনোয়ারা প্রান্তের সংযোগ ঘটাবে।

মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন থাকবে। মূল টানেলের সঙ্গে নদীর দুই প্রান্তে মোট ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযুক্ত সড়ক থাকছে। এছাড়া ৭২৭ মিটার দীর্ঘ একটি ফ্লাইওভার থাকছে আনোয়ারা অংশে। যার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। আর বহুল কাঙ্ক্ষিত এই বঙ্গবন্ধু টানেল এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031