বহুল প্রচারিত বাণীটি হলো, “একটি দুর্ঘটনা, সারা জীবনের কান্না। গাড়ি চালাতে সাবধানতা অবলম্বন করুন।” বিভিন্ন যানবাহনের গায়ে একটি বাণী সচরাচর চোখে পড়ে। বাণীটির কার্যকারিতা শোভা বর্ধনেই সীমাবদ্ধ। এসব বাণী কেউ মেনে চলে, না বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় তা নিয়ে হয়ত প্রশ্ন রয়েছে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত, অযৌক্তিক কারণে দেশে যে হারে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে তাতে কান্নার রোল হয়ত কোনদিন থামবে না। কারণ প্রতিকারে নেই কোন ব্যবস্থা। দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা হয় অনেক, কার্যকর হয় গুটি কয়েক। অনবরত আশ্বাস পেতে পেতে, সেই আশ্বাসে আর বিশ্বাস রাখতে পারছে না মানুষ। একের পর এক দুর্ঘটনায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা সড়কপথে চলাচলে জনমনে এক ধরনের আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বের হয়ে ঘরে ফিরে আসার যেন কোনো নিশ্চয়তা নেই। রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির চাকায় পিষ্ট হচ্ছে স্কুলগামী শিশু, গাড়ি উল্টে খাদে পড়ে মারা যাচ্ছে সাধারণ যাত্রীরা, মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটছে নিহত হওয়ার ঘটনা। দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা ধরনের সুপারিশ ও পরামর্শ দেয়া হলেও তা যে অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হচ্ছে, ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তারই বড় প্রমাণ। সড়কপথে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কথা অনেকেই বলছেন। কিন্তু বিশৃঙ্খলার দাপটই যেন ক্রমবর্ধমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা না গেলে আগামী ১০ বছরে দুর্ঘটনার পরিমাণ হবে দ্বিগুণ। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। কিন্তু সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে এদেশের নীতিনির্ধারকদের মনোভাব দায়সারা গোছের। দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতেও সরকারি পর্যায়ে তেমন উদ্যোগ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে নিসচা সভাপতি জানান, গতিই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। যানবাহনের অতিরিক্ত ও অযাচিত গতির কারণে মৃত্যুসহ আহত ও ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ে। ঘণ্টায় এক কিলোমিটার গতি বাড়লেই দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ৫ শতাংশ বেড়ে যায়। অপরদিকে গড়ে ৫ শতাংশ গতি কমলে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ৩০ ভাগ কমানো সম্ভব। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তাগণ। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) দেবদাস ভট্টাচার্য আজাদীকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার আইন অত্যন্ত দুর্বল। আমাদের পুলিশ বিভাগ থেকেও বলা হয়েছে আইন সংশোধন করার জন্য। আইন যা তাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার পর আদালতে অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যায়। ফলে শাস্তিও দেয়া যায় না। তিনি হাইওয়ে রোডে আইন অমান্য করে হালকা যান চলছে মন্তব্য করে বলেন, এ সব সড়কে বড় যানবাহন খুব দ্রুত গতিতে চলে। কিন্তু হালকা যানবাহনগুলোর তো এত গতি থাকে না। তাই বড় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছোট গাড়িকে আঘাত করে। গতকাল চন্দনাইশে বাস, ট্রাক ও টেম্পুর ত্রিমুখী সংঘর্ষে নারী–শিশুসহ নিহত হয়েছেন ৬ জন এবং আহত হয়েছেন ১০ জনের বেশি। গতকাল নগরীতে ইপিজেডগামী একটি রাইডার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের ডিভাইডারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই দুইজন নিহত হয়েছেন। তাদের একজনের বয়স ৩০ ও আরেকজনের বয়স আনুমানিক ৩৫ বছর।
অভিযোগ রয়েছে দায়িত্ব পালনে পুলিশের অবহেলা ও হয়রানির কারণে বাংলাদেশে দুর্ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না। সঠিক প্রতিবেদনের অভাব এবং ভুল ব্যাখ্যার কারণে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না। দুর্ঘটনার পর পুলিশকে ৬৭ ধরনের প্রশ্ন সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এই ঝামেলা এড়াতে অনেক সময় তারা অনেক দুর্ঘটনা রেকর্ডভুক্ত করে না বলে জানা যায়। তবে এ অভিযোগের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন সিএমপির সার্জেন্ট (প্রসিকিউশন উত্তর) আনোয়ারুল হক। এপ্রসঙ্গে তিনি আজাদীকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ পেলেই সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ সেখানে পৌঁছে আহতদের হাসপাতালে প্রেরণ, নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণসহ প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। এখানে গা বাঁচানোর কোন সুযোগ নেই।
মহানগর পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, দুর্ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে যেগুলোকে মোটা দাগে চিহ্নিত করা যায় সেগুলো হচ্ছে– অদক্ষ চালক দ্বারা যানবাহন চালনা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়কে নামানো, চালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বাস ও ট্রাক হেলপারদের ভুল সংকেত প্রদান, চলন্ত অবস্থায় বাসে যাত্রী উঠানো ও নামানো, যানবাহন পরস্পরকে বিপরীত দিকে ক্রস করার সময় যানবাহনের গতি না কমানো, গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছার লক্ষ্যে সংকেত না দিয়ে ওভারটেকের চেষ্টা, গাড়ি চালনা শুরু করার আগে চালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করা, একই চালককে দিয়ে একাধিক ট্রিপ পরিচালনা ও যানবাহন চালকদের মাদক ব্যবহার। এ ছাড়াও পথচারীদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হওয়ার প্রবণতা, রেলক্রসিং অতিক্রমকালে রেলের সংকেত সম্পর্কে সতর্ক না থাকা, সড়কের নিরাপদ জায়গা ফুটপাত ফেলে সড়কের প্রায় মাঝখান দিয়ে হাঁটাচলাও দুর্ঘটনায় প্রাণহানির অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, সিএনজি চালিত অটোরিকশার মতো হালকা যানের চালকরা অনেক সময় ভারী যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দেয়। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে ওভারটেক করে, কখনো বড় যানবাহনকে সাইড না দিয়ে সড়কের মাঝখান দিয়ে চলতে থাকে।
– See more at: http://www.dainikazadi.org/details2.php?news_id=2409&table=may2017&date=2017-05-26&page_id=1&view=0&instant_status=0#sthash.VMaSmxiH.dpuf