কোথাও মিলছেনা আশার বাণী। হাজেরা বেগমের আহাজারি মিলিয়ে যাচ্ছে শূণ্যে। হতাশা গ্রাস করেছে তাকে। হাসপাতাল, ডাক্তার, আইইডিসিআর কোথাও সাহায্য পাচ্ছেন না। কদিন ধরে হাজেরা বেগম নিজে, তার স্বামী ও এক সন্তান জ্বর, কাশিতে ভূগছেন। তিনি এসবকে করোনার লক্ষণ মনে করছেন। তাই মনে ধুকেছে ভয়। আতঙ্ক।
সত্যিই তারা করোনায় আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য
দৌড়ঝাঁপ করছেন। কোথাও সহযোগিতা পাচ্ছেন না। হাজেরা বেগম বলেন, এখন আমি
একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছি। দুই দিন ধরে আমার ছেলে বহু বার ফোন করেও পায়নি
আইইডিসিআরের কাউকে। কখনো লাইন ব্যস্ত, কখনো রিং বেজে যায় কোন রেসপন্স নেই।
সর্বশেষ আজ সংযোগ পায়। ফোনে সব বলার পর জানানো হয় আরো দুই দিন দেখার জন্য।
এরপরও যদি না কমে তাহলে জানালে তারা স্যাম্পল নিয়ে যাবেন। হাজেরা বেগমের
প্রশ্ন তাদের বিষয়টি জানাতেই দুইদিন লেগেছে। এখন দুইদিন পর যদি জ্বর, কাশি
না কমে সেটা জানাতে কদিন লাগবে? হাজেরা বেগম বসবাস করেন ৩২৬/২/বি
যাত্রাবাড়ীর নিজ বাড়িতে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে
যোগাযোগ করেছি।। তারা বলেছেন আগামীকাল যেতে। সর্বশেষ শুক্রবার মুগদা আামার
খালাত ভাইকে ফোন করি। তিনি কিছুদিন মুগদা হাসপাতালে চাকরি করেছেন। সব শুনে
তিনি এক ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে আমাকে জানান সন্ধ্যার পর উই ডাক্তার
জানাবেন আমাদের কি করতে হবে। রাতে খালাত ভাই ফোন করে বলেন আজ সকালে যেন
হাসাতালে যাই। আজ শনিবার বেলা একটায় হাজেরা জানান, এইমাত্র মুগদা হাসপাতালে
টেস্ট করাতে দিয়ে এসেছি। সোমবার রিপোর্ট দিবে। তিনি বলেন, আমরা প্রাথমিক
চিকিৎসা হিসাবে পানির সঙ্গে আদা আর লবঙ্গ মিশিয়ে গরম ভাপ নিচ্ছি। গরম পানি,
চা খাচ্ছি। কিন্তু ভয় হচ্ছিল পরীক্ষা করাতে পারছি না। নিশ্চিত হতে পারছি
না আমরা করোনায় আক্রান্ত কিনা? আপাতত সে ভয়টা আজ কাটল।
চারদিকে ভয়।
করোনা আতঙ্ক। তারপরও মহল্লায় মহল্লায় মানুষের জটলা। প্রতিদিন বাড়ছে করোনা
আক্রান্তের সংখ্যা। টিভি খুলে বসে থাকে মানুষ আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা
জানতে। এতটুকুই যেন আগ্রহ। বাজারে শিমুল নামের এক লোক সেলিম নামের একজনকে
চিৎকার করে বলছেন- একেবারেই যে দেখা যায়না আপনাকে। ঘরবন্দি হয়ে কি বাঁচতে
পারবেন? মরন যেদিন আসবে কেউ আটকাতে পারবেনা। এই যে দেখুন আমি প্রতিদিন
বেরুচ্ছি। হাটছি। যা হবার হবে। আল্লাহ ভরসা। অথচ এ সময়ে কারো স্বাভাবিক
মৃত্যু হলেও নানা প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয় স্বজনদের। ১৩২৬ গ্যাস রোডের বাড়ির
মালিক আব্দুল ওয়াদুদের ভাই মারা গেছেন। তিনি আগে থেকেই কিডনি রোগী ছিলেন।
হঠাৎ তার পেট ফুলে যায়। পায়ে পানি জমে যায়। দ্রুত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরদিন তার মৃত্যু হয়। তার লাশ তরিঘরি করে হাসপাতাল
থেকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় মাতুয়াইল গোরস্থানে। সেখানে নিরবে দাফন করা হয়।
তার মৃত্যুর বিষয়টি ওই বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদেরও জানানো হয়নি। এ
ব্যাপারে আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও লাশ মহল্লায় আনতে
পারিনি ভয়ে। সমাজের মানুষ অন্য চোখে দেখবে। নানা প্রশ্ন করবে। তাই আত্মীয়
স্বজনদের সঙ্গে পরামর্শ করে সোজা গোরস্থানে নিয়ে দাফন করেছি।
রমজানে
মসজিদে সর্বোচ্চ১২ জন তারাবীর নামাজ আদায় করতে পারছেন। অন্যদের ঘরে নামাজ
আদায় করতে বলা হয়েছে। অথচ রাতে ছাদে গিয়ে তাকালে দেখা যায় আশপাশের বাড়ির
ছাদে তারাবীর জামাত হচ্ছে। এ ব্যাপারে আহমেদ হোসেন নামে একজন বলেন, কি করব
বলুন। আমাদের বাড়ির লোকজনই এক হয়ে ছাদে তারাবীর নামাজ পড়ছি। বাইরের কেউ
আসছেনা। এক বাড়ির সবাই বলে ভয়টা কম। আপনারা কি বাইরে যাননা? তার উত্তর
-বাজার করতে সবাই যাচ্ছি। তাহলে সেখান থেকে যদি কেউ করোনা ভাইরাস বহন করে
নিয়ে আসে? আর এভাবে তো সবার মাঝে ছড়াতে পারে। তিনি বলেন, কপালে থাকলে কি আর
করা।
সমাজের বেশিরভাগ মানুষ কোয়ারেন্টিন মানছেন না। ঘরে থাকছেন না।
শুধুমাত্র দূরে কোথাও যাচ্ছেন না। কিন্তু নিয়মিত ঘরে বাইরে আসা যাওয়া
করছেন। এ অবস্থায় গোটা দেশই অনিরাপদ। ভয় আর আতঙ্ক শুধু মানুষের মুখে মুখে।
অন্তরে ভয়টা প্রবেশ করেনি। আর তাই হাটে বাজারে, পথে ঘাটে মানুষের ভিড়।
কোথাও মানা হচ্ছেনা সামাজিক দূরত্ব। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি খুলে দিয়ে আরো এক
ধাপ বিপদ ডেকে আনা হয়েছে। এ সবের ফলাফল হলো দিন দিন করোনা আক্রান্তের
সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া। রায়েরবাগের চৌধুরী ফার্মসীতে ব্যারিকেড দেয়া হয়া
হয়েছে কেউ যেন ভেতরে যেতে না পারে। এর মালিক বশির আহমেদ বলেন, কোনভাবেই
মানুষকে বুঝাতে পারছিনা। তারা ওষুধ নিতে এসে একেবারে ঘাড়ের উপর উঠে যায়।
বাধ্য হয়ে ব্যারিকেড দিয়েছি। তিনি বলেন এমন পরিস্থিতিতেও যে দেশের মানুষ
কিছু বুঝতে চায়না তাদেরতো বিপদ আসবেই। বৃহস্পতিবার ব্যাংকে টাকা তুলতে যান
মাকসুদুর রহমান। তিনি বলেন লম্বা লাইন। কমপক্ষে ৫০ জনের পেছনে পড়েছি। দুই
ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে টাকা তুলতে পেরেছি। তিনি বলেন, ব্যাংকের সিকিউরিটিরা
বারবার তাগাদা দিয়েও দূরত্ব বজায় রাখতে পারেনি। আমরা একজনের সঙ্গে আরেকজনের
লেগে দাড়াতেই যেন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
