পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে তার ক্ষমতাচ্যুতি নিশ্চিত করেছে । এই সংবাদ যখন প্রকাশিত হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের বিচার বিভাগের তুলনাটা যেন অবধারিতই ছিল। হয়েছেও তা-ই। অনেকেই তুলে আনছেন পুরোনো প্রসঙ্গও। সাবেক প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহম্মদ চৌধুরী যে সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের হটিয়েছেন, সেই প্রসঙ্গও উঠে এলো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানীকেও নওয়াজের মতো একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছিল। খোলা চোখে দেখলে, বিচার বিভাগের সক্ষমতার এর চেয়ে বড় প্রমাণ বোধ হয় আর হয় না। একজন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে এক অঙ্গুলি হেলনে বহিষ্কার করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নওয়াজের বিরুদ্ধে এই রায়কে বড় কিছু বলে মনে হবে না।
প্রথমে আসি সাবেক প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীর অধ্যায়ে। ২০০২ সালে যখন তিনি সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি হন, তখন পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তাল। মোশাররফের লিগ্যাল অর্ডিন্যান্স ২০০২ পাশ হয়নি, কারণ পার্লামেন্টে তার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। আর তখন পারভেজ মোশাররফের অধীনে শপথ নিয়ে ওই অর্ডিন্যান্সকে কার্যত বৈধতা দেন বিচারপতি ইফতিখার। পরে মোশাররফই ২০০৫ সালে তাকে প্রধান বিচারপতি করেন। কিন্তু দুই বছর পর ২০০৭ তাকে বরখাস্ত করা হয়। বাকিটা ইতিহাস। পরের বছরই উল্টো ক্ষমতা হারান মোশাররফ।
কিন্তু বিচারপতি ইফতিখারের লড়াইটা যতটা না ছিল সুপ্রিম কোর্টের ‘ইন্টেগ্রেটি’র মাধ্যমে, তার চেয়েও বেশি ছিল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। মোশাররফের বরখাস্তের আদেশের পরপরই আন্দোলনে নামেন আইনজীবীরা। এর ফলে ৫ মাস পরই প্রধান বিচারপতি হিসেবে পুনর্বহাল করা হয় ইফতিখার চৌধুরীকে। কিন্তু চার মাসের মাথায় জরুরী অবস্থা জারি করে ইফতিখার চৌধুরীকে গ্রেপ্তার এবং ৬০ বিচারপতিকে বরখাস্ত ও গৃহবন্দী করেন মোশাররফ। কিন্তু পরের বছরই অর্থাৎ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভরাঢুবি ঘটে তার সমর্থনকারী দল পিএমএল (কিউ)-এর আসন সংখ্যায়। বিরোধী দলগুলোর অভিশংসনের হুমকির মুখে তিনি এক পর্যায়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে আবার নওয়াজের দলের আন্দোলনের মুখে ২০০৯ সালে প্রধান বিচারপতি পদে আসীন হন ইফতিখার চৌধুরী।
পুরো বিষয়টি ছিল ইফতিখার চৌধুরীর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জোটের লড়াই। যে লড়াইয়ে তিনি বিজয়ী হন, আর হারেন মোশাররফ। জরুরী অবস্থা চলাকালে ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ সাহস দেখিয়েছিলেন ইফতিখার চৌধুরী। কিন্তু আরেকজন প্রধান বিচারপতিও এই সাহস দেখাতে পারতেন, তার নিশ্চয়তা ছিল কি? ফলে ব্যক্তি ইফতিখার চৌধুরীর এই উদাহরণকে সামগ্রিকভাবে বিচার বিভাগের শক্তিমত্তার প্রমাণ হিসেবে দেখাটা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
আবার তাই বলে বিচার বিভাগ ফেলনা নয় পাকিস্তানে। একটি আদর্শ রাষ্ট্রে তিনটি স্তম্ভ থাকে: পার্লামেন্ট, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ। সংসদীয় গণতন্ত্রে পার্লামেন্ট ও নির্বাহী বিভাগের নেতৃত্বে সরাসরি থাকে রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু পাকিস্তানে এই রাজনৈতিক শক্তি বরাবরই সেনাবাহিনীর বুটের তলায় পিষ্ট ছিল। ফলে সেনাবাহিনী যদি হয় পাকিস্তানের প্রধান শক্তি, বিচার বিভাগ ও রাজনৈতিক শক্তি এখানে দ্বিতীয় হওয়ার দৌড়ে লড়ছে। অতীতে বিচার বিভাগ ও রাজনৈতিক শক্তি এক হয়ে সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করার নজির রয়েছে ওই একবারই। কিন্তু এবার সেনাবাহিনীর বেঁধে দেওয়া নিয়মে খেলে পাকিস্তানের ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক শক্তির বড় ক্ষতি করে দিয়েছে বিচার বিভাগ।
যেই নওয়াজ শরীফ সেবার ইফতিখার চৌধুরীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন (যার ফলে তিনি নিজেও রাজনৈতিকভাবে ভীষণ লাভবান হন), সেই নওয়াজকেই এবার সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করলো। নওয়াজ রাজনৈতিকভাবে ও ব্যবসায়িকভাবে খুব ‘শরীফ’ ব্যক্তি নন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পাকিস্তানে সামরিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সামর্থ্যবান ব্যক্তিটি তিনিই। তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। প্রতিবারই মেয়াদ পূরণের আগেই তাকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেই পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করেন।
গত বছরের শেষের দিকে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করেন বিরোধী দলীয় নেতা ও সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান। তার আন্দোলনে, বিশেষ করে ইসলামাবাদ অবরোধে সেনাবাহিনীর সমর্থনের কথা সুবিদিত। সেনাবাহিনী প্রধান বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, আন্দোলনকারীদের ওপর কোনো দমনপীড়ন চালানো উচিৎ হবে না। দেশের রাজধানী অবরোধ করে ফেলা হয়েছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হয়েও শক্তি প্রয়োগ করতে পারছিলেন না নওয়াজ। কিন্তু তিনি সেবার সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ফ্রন্ট ইমরানকে কাবু করেন রাজনৈতিকভাবে। নজিরবিহীনভাবে প্রধান বিরোধী দল পিপলস’ পার্টির সমর্থন নিয়ে তিনি পার্লামেন্টে ইমরানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেন। সেবার পিছু হটতে বাধ্য হন ইমরান খান।
ভারত নিয়ে নীতিনির্ধারণে আরও বেশি ক্ষমতা চাচ্ছিল সেনাবাহিনী। তার বিনিময়েই কিনা কে জানে, তৎকালীন সেনাপ্রধান রাহীল শরিফ সেবার ক্ষমতা গ্রহণে অনিচ্ছার কথা জানান। অনেক জেনারেল চেয়েছিলেন হস্তক্ষেপ করতে, কিন্তু রাহীল তাদেরকে শান্ত করেন।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে নওয়াজের তিক্ততার অনেক উদাহরণ রয়েছে। পাকিস্তানের শীর্ষ পত্রিকা ডনে’র এক সাংবাদিক ও কলামিস্ট সাইরিল আলমেইদা একবার আচমকা এক বোমা ফাটানো সংবাদ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি বর্ণনা করেন একটি বৈঠকের কথা, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজের ইন্ধনে ও উপস্থিতিতে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র প্রধানকে একরকম কোণঠাসা করে ফেলেন প্রধানমন্ত্রীর ভাই ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে বলে আইএসআই প্রধানকে হুশিয়ারি দেওয়া হয়। দু’ জনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়। এই কাহিনী ফাঁসের পর সাংবাদিক সাইরিলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তাকে অপসারণের দাবি জানায় একটি তদন্ত কমিটির সামরিক প্রতিনিধিরা। কিন্তু নওয়াজ তাদের দাবি পূরণ করেননি। এরপর নজিরবিহীনভাবে টুইটারে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয় সেনাবাহিনী।
ইকোনমিস্টের একটি নিবন্ধে বলা হয়, যখনই ভারত ও পাকিস্তানের রাজনীতিকরা একটু ঘনিষ্ঠ হন, তখনই কিছু ঘটনা ঘটে, যাতে দু’ পক্ষকেই পিছু হটতে বাধ্য হতে হয়। যেমন, নওয়াজ শরীফের বাসায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আকস্মিক সফরের মাধ্যমে দু’ দেশেই যেন আশা ছলকে উঠেছিল। কিন্তু ক’ দিন বাদেই দেখা গেল, ভারতে সেনাদের ওপর জঙ্গি হামলা। ফলে সম্পর্কে একটু উষ্ণতার সম্ভাবনা মুহূর্তেই মাটি হয়ে গেল। ইঙ্গিতটা স্পষ্টতই সেনাবাহিনীর দিকে, যাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি তোষণের অভিযোগ অনেক পুরোনো।
নওয়াজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগটা খুব বড় কিছু নয়। তিনি একটি কোম্পানির কর্মকর্তা হিসেবে মাসে ৩ হাজার ডলার মাইনে পেতেন, যেটা তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেননি। এখানে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দুর্নীতি করেছেন বা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তার অস্বচ্ছতা ছিল বটে। সেজন্য তাকে বড়জোর তিরস্কার করা যায়। আগামী বছরেই ভোটারদের রায়ে নওয়াজের ফয়সালা হতে পারতো। কিন্তু বিচারকরা তাকে ‘অসৎ’ বলে সাব্যস্ত করে ভোটারদের দায়িত্ব যেন নিজেরাই পালন করে ফেললেন। ব্লুমবার্গ যেমনটি লিখেছে, ভোটারদের দায়িত্ব পালন করা সুপ্রিম কোর্টের কাজ নয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক হাস্যকর নিয়ম সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেছিল, যেখানে বলা আছে যে রাজনীতিকদের হতে হবে ‘সৎ’ ও ‘ন্যায়নিষ্ঠ’। তাই, ‘অসৎ’ হিসেবে পরিগণিত নওয়াজ শরীফের আর প্রধানমন্ত্রী থাকা সম্ভব হলো না। অর্থাৎ, সেনাবাহিনীর বেঁধে দেওয়া নিয়মেই খেললেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা। সুপ্রিম কোর্ট হয়তো টেকনিক্যালি সঠিক। কিন্তু যেই অস্পষ্ট বিধানের দোহাই দিয়ে নওয়াজকে একরকম সাজা দেওয়া হলো, সেই বিধানের অস্পষ্টতার ফয়সালা আদালত করেনি। উপরন্তু, তদন্ত সংস্থা জেটিআই, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিও ছিল, তারা দৃশ্যত আক্রমণাত্মক আচরণ করে নওয়াজের ব্যাপারে। ধারণা করা হয়, তদন্তে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করেছে সেনাবাহিনী। এই তদন্ত সংস্থার পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে হস্তক্ষেপ করেনি সুপ্রিম কোর্ট।
আরও বড় কথা হলো, নওয়াজের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবিতে ইমরান খানেরা যখন পিটিশন দাখিল করতে চেয়েছিলেন, তখন সুপ্রিম কোর্ট আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু ইমরানের আন্দোলনের মুখে একটা পর্যায়ে আদালত পিটিশন গ্রহণে ‘সম্মত’ হলেন। অর্থাৎ, এখানেও রাজনীতি ভূমিকা রেখেছে। অবশ্য, পানামা পেপার্সে নওয়াজ পরিবারের মালিকানাধীন কোম্পানির তথ্য ফাঁসও এক্ষেত্রে বড় অনুঘটক ছিল।
নিউ ইয়র্ক টাইমস সম্পাদকীয় পর্ষদ যেমনটি লিখেছে, পাকিস্তানের রাজনীতিকরা সততার প্রতিমূর্তি নন। আর ‘দুর্নীতি’ও নওয়াজের ক্ষমতাচ্যুতির কারণ নয়। নওয়াজ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ পাননি। ইকোনমিস্ট লিখেছে, এই রায়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট যে নজির সৃষ্টি করলো, সেটা বেশ প্রশস্ত। এই প্রশস্ত জালে অনেকেই ধরা পড়তে পারেন। এমনকি যেই ইমরান খান নওয়াজকে নিয়ে এত সোচ্চার ছিলেন, তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির মামলা চলছে। ফলে এই জালে তিনিও ধরা পড়তে পারেন।
পুরো বিষয়টিতে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে সেনাবাহিনী। বেসামরিক প্রশাসনের আধিপত্য নিশ্চিতে আগ্রহী নওয়াজের পতন হলো। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরীক্ষা হয়ে গেল? দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে রাজনৈতিক শক্তি সবচেয়ে ক্ষমতাধর হলেও, পাকিস্তানে সেটি সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী বিচার বিভাগের ওপরও ছড়ি ঘুরিয়েছে। সন্ত্রাসবাদের দায়ে অভিযুক্ত বেসামরিক মানুষকে সামরিক আদালতে বিচার করাতে আগ্রহী ছিলেন সেনাপ্রধান রাহীল শরীফ। সেখানে যা হয়, সেটাকে বিচার না বলাই শ্রেয়। কেউ অভিযুক্ত হলে, তাকেই প্রমাণ করতে হয় যে, তিনি দোষী নন। সাজার হারও শতভাগ। অর্ধেকেরও বেশি পেয়েছে মৃত্যুদ-, বাকিরা বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-। যদিও এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক শক্তির অনুমোদনেই হয়েছে, তবুও বলা যায় বিচার বিভাগ এই ভয়াবহ অবিচার বন্ধে কোনো চেষ্টা করেনি।
তাই পাকিস্তানের বিচার বিভাগ আদতে কতটা শক্তিশালী, সেটার প্রমাণ অন্তত নওয়াজকে অপসারণের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বোঝা গেল না। বিচার বিভাগ যেদিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এ ধরণের কোনো পদক্ষেপ নিতে পারলেই সেটাকেই ‘সাহসিকতা’ বলা যাবে।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031