দুই বন্ধুর বাবা-মায়ের কথা লিখেছিলাম। এইতো সেদিন। তাদের কেউই আইসিইউ থেকে ফিরতে পারেননি। কুমিল্লায় আমাদের আরেক বন্ধু। বয়স কতইবা হবে। ৩৭-৩৮। এ বয়সেই চলে গেল! হল জীবনের খুব কাছের বড় ভাই। বর্তমানে পেশায় ব্যাংকার। শ্বশুর মারা গেছেন। শাশুড়ি বাসায় আক্রান্ত। স্ত্রী হাসপাতালে। দুই শিশু সন্তান বাসায়। একজন করোনায় আক্রান্ত। এক নিকটাত্মীয়া এক মাস ধরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে। অক্সিজেন সাপোর্টে।

এই বাস্তবতা বাংলাদেশের সর্বত্র। ফেসবুক যেন ডেথবুক! খুললেই কারো না কারো মৃত্যু, আক্রান্তের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি তার খুব কমই প্রকাশ করতে পারছে। তবুও প্রতিদিনই মৃত্যু, শনাক্তে রেকর্ড হচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা দু’শর নিচে নামছেই না। এটা তো শুধু হিসাবের খাতা। উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়াদের নাম ওঠছে না কোনো তালিকায়। গ্রামে গ্রামে মানুষের জ্বর-সর্দি। পরিস্থিতি খুব খারাপ না হলে তারা কেউই হাসপাতালমুখী হচ্ছেন না। পরীক্ষাতো পরের কথা!

তবুও নানা গুঞ্জন, গুজব। করোনার ভয়াবহতা হয়তো এখনো অনেকে উপলব্ধি করতে পারছেন না। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান ডা. শাহজাদ হোসেন মাসুম। প্রায়ই তিনি ফেসবুকে পরিস্থিতির কিছুটা বিবরণ দেন। সম্প্রতি তিনি লিখেছেন, একটা প্যান্ডেমিক যার মৃত্যুহার আপনার কাছে কম, আমাদের কাছে বেশি। আমাদের ওয়ার্ড উপচানো রোগী। আমরা আমাদের সক্ষমতার বাইরে রোগী নিচ্ছি। আমাদের ওয়ার্ডের, ইমারজেন্সির, ট্রায়াজের চিকিৎসকরা ক্লান্ত। তাঁদের কাছে মৃত্যুহার কিন্তু এক বা দুই পারসেন্ট নয়। পাঁচ থেকে সাত পারসেন্ট। তাঁরা আতঙ্কিত। আর আমরা যারা আইসিইউতে কাজ করছি, আমাদের কাছে মৃত্যুহারটি চল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন পারসেন্ট। আমরা ক্লান্ত, অবসন্ন, বিষণœ। আমরা আতঙ্কিতও। আমদের কাছে কোভিডের চেহারা আর আপনাদের কাছে কোভিডের চেহারা এক নয়। ব্রিফিংয়ের সময় আইসিইউর সামনে দাঁড়িয়ে রোগীদের স্বজনদের মুখগুলো দেখে যেতে পারেন।

এই ভয়াল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপ কী? দ্বিতীয় দফায় কঠোর লকডাউন চলছে। সরকার অবশ্য লকডাউন শব্দ ব্যবহার করে না। সরকারি ভাষায় বিধিনিষেধ। মন্ত্রীরা বারবার বলেন, এবার আরও কঠোর হবে? তো সে কঠোর বিধিনিষেধ কেমন চলছে! ঢাকায় অলিগলিতে মানুষের ভিড়। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে। পায়ে হেঁটে ফার্মগেট থেকে কাওরান বাজার পর্যন্ত আসতে অন্তত ৬০টি গাড়ির দেখা পেলাম। যেন বিএনপির ডাকা ঢিলেঢালা হরতাল।

এটা অবশ্য প্রশ্ন আছে, বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে এখনো দারিদ্রসীমার নিচে লাখ লাখ মানুষ বাস করে সেখানে লকডাউন কতটা কার্যকর করা সম্ভব? জীবনের চেয়ে কখনো কখনো জীবিকার প্রশ্ন বড়। সেক্ষেত্রে লকডাউনের বিকল্পও তেমন খোঁজা হয়েছে কি? শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাও হয়তো এখানে সবসময় সম্ভব নয়। কিন্তু মাস্ক? সেটাও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি! বহু মানুষের মুখে মাস্ক নেই। গরিবদের মাস্ক সরবরাহের সরকারি ব্যবস্থাও এখনো চোখে পড়েনি। কেউ কেউ আবার থুতনিতে মাস্ক পরে করোনা প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন।
করোনা আসলেই এক রহস্যময় ব্যাধি। এর অনেক কিছু এখনো অজানা। শতভাগ কার্যকর টিকাও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কিন্তু দেশে দেশে এটা প্রমাণ হয়েছে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে টিকা দেয়া গেলে করোনায় মৃত্যুহার অনেক নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে সে টিকা দেয়া হচ্ছে অত্যন্ত শ্লথগতিতে। টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুখ্যাতি রয়েছে। কিন্তু এবার কেন যেন সামর্থ্য কাজে লাগানো হচ্ছে না। যদিও বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা আসা শুরু হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যার ৮০ ভাগকে টিকা দিতে কয়েকবছর লাগিয়ে ফেললে আদতে তা কোন ফল দিবে না।

ভয়ঙ্কর এক সময় পার করছে বাংলাদেশ। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। কার কখন ডাক আসে কে জানে? এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পথ কি? প্রথমত এবং বাস্তবে একমাত্র পথ হচ্ছে কয়েকমাসের মধ্যে কয়েক কোটি লোককে টিকা দেয়া। প্রয়োজনে রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থাও বাতিল করতে হবে। যেকোন মূল্যে মানুষকে টিকা দিতে হবে। আর দ্বিতীয়ত মাস্ক পরা নিশ্চিত করা। সবকিছুর পরও বিশ্বাসীদের স্রষ্টার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। আসুন সবাই প্রার্থনা করি।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031