কর্ণফুলী নদী দখল, দূষণ ও নাব্যতা সংকটণ্ডদীর্ঘদিন ধরে এই তিন সমস্যায় আক্রান্ত । সমস্যাগুলোকে দূর করে নদীটিকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে নানা পরিকল্পনার গল্প শুনিয়েছিল নানা সংস্থা। কিন্তু সেইসব পরিকল্পনার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। যা প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চট্টগ্রামের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নদীটিকে অস্তিত্বের সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ের দখলদারদের উচ্ছেদে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা আছে। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী, উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আবার নদীটিকে দূষণমুক্ত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করবে পরিবেশ অধিদপ্তর। এদিকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য প্রকল্প আছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। যদিও এখন পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর গৃহীত কার্যক্রমের দৃশ্যমান অগ্রগতি ‘সন্তোষজনক নয়’ বলে মনে করেন নগরবাসী।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পদস্থ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অবৈধ দখলদারদের অন্যত্র সরে যেতে সম্প্রতি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরে না গেলে জেলা প্রশাসন দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
আবার পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি, দূষণ রোধে তারা নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ড্রেজিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে চীন থেকে ড্রেজার আনা হয়েছে।
এদিকে কর্ণফুলীকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ‘মাস্টার প্ল্যান’ তৈরি করছে। ইতোমধ্যে মাস্টার প্ল্যানের খসড়াও তৈরি করা হয়েছে। আগামী মাসে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠেয় এ সংক্রান্ত কমিটির সভায় মাস্টার প্ল্যান নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে।
কর্ণফুলী গবেষকের বক্তব্য
কর্ণফুলী গবেষক ও সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসীন কলেজের অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, দশ বছর আগে যে কর্ণফুলী ছিল সেই অবস্থায় এখন নেই। কারণ, বর্তমানে কর্ণফুলী নদী একাধিক প্রধান সমস্যায় আক্রান্ত। এর মধ্যে দখল, দূষণ ও নাব্যতা সংকট অন্যতম। দখলদার উচ্ছেদে উচ্চ আদালতের রায় আছে। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের কারণে। কারণ, প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে যারা এখানে আসেন তারা আন্তরিক না। তারা এখানে আসেন, আবার পদোন্নতি নিয়ে চলে যান। কর্ণফুলী মরে গেলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তাই শুধু প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে না থেকে আমরা যারা চট্টগ্রামের তাদেরও আন্তরিক হতে হবে।
এ নদী গবেষক বলেন, প্রাকৃতিক, রাসায়নিক ও বাস্তুতান্ত্রিকণ্ডএই তিন কারণে কোনো একটি নদী মারা যায়। বর্তমানে কর্ণফুলী নদী এই তিনটিতেই আক্রান্ত। বন্যা, খরা ও পাহাড় কাটাসহ বিভিন্ন কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয় এবং বিভিন্ন শিল্পবর্জ্য বা অন্যান্য বর্জ্যের কারণে যখন নদী হুমকির মুখে পড়ে, সেটি হবে রাসায়নিক কারণ। এই দুইয়ের কারণে নদীতে যখন জলজ প্রাণী মারা যাবে তখন সেটি হবে বাস্তুতান্ত্রিক। শিল্পকারখানার বর্জ্যসহ অন্যান্য বর্জ্য তো নদীতে গিয়ে পড়ছে। নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছও বিলুপ্ত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দশ বছর পর কর্ণফুলী আরো পাল্টে যাবে। হারাবে ঐতিহ্য। কর্ণফুলী রক্ষার জন্য ইতোপূর্বে যে দখলদারদের তালিকা করা হয়েছিল তাদের উচ্ছেদের পাশাপাশি নতুন করে যেন আর কেউ দখল করতে না পারে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি মনে করেন, কর্ণফুলী নদীকে রক্ষায় একটি ‘আপডেট ল্যাবরেটরি’ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে কর্ণফুলীর পাড় ঘেঁষে সরকারি স্থাপনা থাকলে সেগুলোও উচ্ছেদের দাবি জানান তিনি।
দখলদার উচ্ছেদ
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলীর দুই পাড়ে ২ হাজার ১৮১ জন দখলদার বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করেছেন। এর মধ্যে আরএস রেকর্ড মূলে কর্ণফুলী নদীর বাকলিয়া ও পূর্ব পতেঙ্গা মৌজায় সর্বমোট ২১১২ জন অবৈধ দখলদার এবং বিএস রেকর্ড মূলে বাকলিয়া, মাদারবাড়ি, গোসাইলডাঙ্গা, মনোহরখালি, ফিরিঙ্গিবাজার মৌজায় মোট ৬০ জন অবৈধ দখলদার আছেন। কর্ণফুলীর তীরে মোট ১৫৮ দশমিক ৪৫ একর ভূমিতে স্থাপনা গড়েছে। স্থানীয়ভাবে ১৫৮ একর ভূমির মূল্য দুই হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গছে, ২০১০ সালের ১৮ জুলাই কর্ণফুলী নদী সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। এই রিটের প্রেক্ষিতে কর্ণফুলী নদী সংরক্ষণ এবং নদী দখল করে গড়ে ওঠা স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না এই মর্মে রুল জারি করেছিলেন আদালত। এছাড়া নদীর তীর দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনার তালিকা আদালতে দাখিল করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ নির্দেশনার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়। আগ্রাবাদ সার্কেলের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ আবু হাসান সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই কমিটির প্রতিবেদনটি ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর উচ্চ আদালতে দাখিল করা হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট হাই কোর্ট উভয় তীরের স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এদিকে রায় ঘোষণার ৬৭৯ দিনে পার হলেও উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা না করায় গত ২৫ মে সিটি মেয়র, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, সিডিএ চেয়ারম্যানসহ ৮ সংস্থার প্রধানকে আদালত অবমাননার নোটিশ পাঠান আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। সর্বশেষ তাদের বিরুদ্ধে গতকাল আদালত অবমাননার রুল জারি করেন উচ্চ আদালত।
অবশ্য এর আগে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষে বলা হয়েছিল, দখলদার উচ্ছেদে তিন দফায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু টাকা মিলেনি। ফলে টাকার অভাবে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর প্রথম চিঠি দেওয়া হয় মন্ত্রণালয়ে। এরপর গত ৮ জানুয়ারি ও সর্বশেষ ১৫ মে চিঠি দেওয়া হয়।
এদিকে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড় রক্ষায় উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন না হলেও নদীটির বিভিন্ন অংশে নতুন করে দখল হচ্ছে। বিশেষ করে চাক্তাই ও রাজাখালী অংশে দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। এর মধ্যে কর্ণফুলী নদী সংলগ্ন রাজাখালী খালের তীর ভরাট ও দখল করে মাছ ধরার ছোট বড় নৌকা তৈরি করা হচ্ছে। দখলকৃত জায়গা থেকে আবার ভাড়াও আদায় করে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল।
এছাড়া ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী তীরে যে মাটি ভরাট করা হয়েছিল সেখানেও নতুন নতুন স্থাপনা গড়ে উঠছে। দখল করা জায়গার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে নৌকা বোটের জন্য ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। খালের তীরে নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য টং ঘর ও খোলা পায়খানা বানানো হয়েছে। নদীর তীরে ড্রেজিংয়ের ভরাট মাটি দখল করে নতুন ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে।
কর্ণফুলীর দূষণ
নানা কারণে এই নদীটি পড়েছে দূষণের কবলে। নদীটির দূষণ প্রসঙ্গে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স কমিটির সভায় পরিবেশ অধিদফতরের তৎকালীন মহাপরিচালক রইছ উল আলম বলেছিলেন, কর্ণফুলী নদীর তীরে ১৩৩টি কারখানা রয়েছে, যেগুলো নদীতে তরল বর্জ্য ফেলছে। এর মধ্যে ১২৩ প্রতিষ্ঠানের ইটিপি কাগজে–কলমে আছে। ১০টি প্রতিষ্ঠানে নেই।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, কর্ণফুলী নদীর পাড়ে এবং আশপাশে গড়ে ওঠা প্রায় ৩০০–৪০০টি ছোট–বড় কলকারখানার বর্জ্যসহ নগরীর অন্যান্য কঠিন বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে ফেলার কারণে কর্ণফুলীর বাস্তুসংস্থান বিনষ্ট হচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে নদীর পরিবেশ।
কর্ণফুলী নদীর দুই পাশে বিদ্যমান পেপার মিল, রেয়ন মিল, সার কারখানা, অয়েল রিফাইনারি, পাওয়ার প্ল্যান্ট, সিমেন্ট কারখানা, ডাইং ও ওয়াশিং কারখানা, ট্যানারি শিল্প, সাবান তৈরির কারখানা ও অন্যান্য শিল্প কারখানা হতে নির্গত বর্জ্যের কারণে প্রধানত কর্ণফুলী দূষিত হচ্ছে বলেও ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া ডাইং, ওয়াশিং, ট্যানারি ও পেপার মিলের অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ইটিপি দ্বারা শোধন ব্যতীত কর্ণফুলীতে পড়ায় নদীর দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চট্টগ্রাম ওয়াসা পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ না করলে দিনে দিনে কর্ণফুলী নদীর পানিতে আরো বেশি পরিমাণে তরল বর্জ্য পতিত হবে এবং সাথে সাথে কর্ণফুলীর দূষণও বৃদ্ধি পাবে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কঠিন বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা এখনো পরিবেশসম্মতভাবে পরিচালিত হয় না উল্লেখ করে বলা হয়, দিনে দিনে বিপজ্জনক পলিথিনসহ কঠিন বর্জ্যের দ্বারা বিপজ্জনকভাবে কর্ণফুলী নদী দূষিত হচ্ছে এবং এর মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নাব্যতা বৃদ্ধিতে ড্রেজিং
কর্ণফুলী নদী ড্রেজিংয়ের জন্য গত ৫ মে নৌ–বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চুক্তির আওতায় ২৪২ কোটি টাকায় সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত ড্রেজিং করা হবে। উত্তোলন করা হবে ৪৩ লাখ ঘন মিটার মাটি। ইতোমধ্যে খনন কাজ শুরুর জন্য সাফির–১ ও মিথাইল–১ নামে দুটি ড্রেজারও আনা হয়েছে। তবে বর্ষার কারণে আপাতত কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এর আগে ২০১১ সালের ৫ জুলাই ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং অ্যান্ড ব্যাংক প্রটেকশন’ নামে ২২৯ কোটি ৫৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ; যা ২০১৩ সালের আগস্টে বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় ড্রেজিংয়ের কাজ পায় মালয়েশিয়ার মেরিটাইম অ্যান্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন। ড্রেজিংয়ের ওই প্রকল্পের আওতায় বন্দরের দুই কিলোমিটার উজানে সদরঘাট জেটির ১০০ মিটার ভাটি থেকে তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুর ৫০০ মিটার উজান পর্যন্ত অংশে নদীর নাব্যতা ফেরাতে ৩৬ লাখ ঘনমিটার বালি/মাটি ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপসারণের কথা ছিল। একই প্রকল্পে ২ হাজার ৬১৫ মিটার দৈর্ঘ্যের তীর নির্মাণ, মেরিন ড্রাইভ তৈরি এবং সদরঘাট এলাকায় ৪০০ মিটার লাইটারেজ জেটি নির্মাণের কথা ছিল। ড্রেজিং শেষ হলে সংশ্লিষ্ট নদী এলাকার গভীরতা চার মিটার এবং নদীর সঙ্গে যুক্ত মূল দুই খাল রাজখালী ও চাক্তাইয়ের সম্মুখভাগের গভীরতা আরো বাড়ার কথা ছিল। প্রকল্পের কাজ পাওয়া মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠানটির সাথে চুক্তি ছিল, কাজ শুরুর ৬শ দিনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হবে। সে হিসেবে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় ২০১৪ সালের ১৩ এপ্রিল তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং’ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ২০১৬ সালে বুয়েট দ্বারা সমীক্ষা চালিয়েছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। সদরঘাট থেকে চর বাকলিয়া পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকায় নদীর ৪২ লাখ ঘনমিটার বালিসহ বর্জ্য অপসারণ করা হবে এ প্রকল্পের আওতায়। ড্রেজিং সম্পূর্ণ হলে এই অংশে চার থেকে পাঁচ ফুট ড্রাফটের জাহাজ চলাচল করতে পারবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে বন্দরের এক জরিপে ড্রেজিংয়ের জন্য নির্ধারিত স্থানে ৩৩ দশমিক ৮৮ লাখ ঘনমিটার মাটি জমার প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে এর পরিমাণ আরো অনেক বেড়ে গেছে। আগের প্রকল্পের একটা মূল সমস্যা ছিল নদীর সঙ্গে যুক্ত খালের মোহনায় মিউনিসিপ্যাল বর্জ্য জমে থাকার বিষয়টি বিবেচনায় না নেওয়া। এর ফলে যেখানে পলিথিন জমেছিল সেখানে কাজ করতে গিয়ে ড্রেজার আটকে যাচ্ছিল। তাছাড়া বৃষ্টি হলেই লাখ লাখ টন পলিথিন এসে জমা হয়। তাই নতুন প্রকল্পে সেসব বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রশাসনের বক্তব্য
উচ্ছেদ কার্যক্রম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান বলেন, আমাদের দায়িত্ব ছিল উচ্ছেদ। ইতোমধ্যে উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ৯০ দিনের মধ্যে সরে যেতে বলা হয়েছে দখলদারদের।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ৯০ দিনের মধ্যে দখলদারদের সরে যেতে নোটিশ ইস্যু করেছি। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তারা সরে না গেলে আমরা অ্যাকশনে যাব। মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ না পেলেও উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তো কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছি। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিলাম। আমরা ভিন্ন পদ্ধতিতে এগোচ্ছি।
আদালতের রায় বাস্তবায়ন না করার পর নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, এরপরই নোটিশ দিয়েছি। গতকাল জারি করা উচ্চ আদালতের রুল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা জবাব দেব। ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছি।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, উচ্ছেদের বিষয়ে আমাদের তেমন কিছু করার নেই। এটা দেখবে জেলা প্রশাসন। তবে আমাদের যতটুকু সহায়তা করা প্রয়োজন ততটুকু করব। দূষণ রক্ষায় গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নিয়মিত মনিটরিং করছি। আমাদের বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মপরিকল্পনা আছে। সেগুলো বাস্তবায়ন করছি। বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর দূষণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দূষণের মাত্রা সবসময় কম–বেশি থাকে।
সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, কর্ণফুলী নদী নিয়ে মাস্টার প্ল্যান করা হচ্ছে। খসড়া তৈরি হয়েছে। এটার উপর ভেটিং হবে। তিনি বলেন, দূষণ, নাব্যতা ও দখল এই তিন সমস্যা আছে কর্ণফুলী নদীতে। দূষণ রোধ করার জন্য জনসচেতনতা প্রয়োজন। যেমন বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ইটিপি থাকে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তদন্তে গেলেই তারা ইটিপি চালায়, বাকি সময় বন্ধ থাকে। কর্ণফুলীকে রক্ষায় বিচ্ছিন্নভাবে না করে সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম সম্পর্কে মেয়র বলেন, খবর নিয়ে জেনেছি, ইক্যুইপমেন্ট আনা হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টির জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। হয়ত এ বর্ষায় সম্ভব হবে না।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল ও কদমতলী ফ্লাইওভার, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধন করার জন্য চট্টগ্রামে এসেছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, কর্ণফুলী রক্ষায় সব প্রদক্ষেপ নেওয়া হবে। কর্ণফুলী নদীকে দূষণমুক্ত রাখার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। বন্দর ও চট্টগ্রামের জন্য কর্ণফুলী নদী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
