নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টি স্বচক্ষে দেখতে মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি টেকনাফের আশ্রয় শিবির পরিদর্শনে আসে।গত ডিসেম্বরের ঘটনা। নৌপথে কর্মকর্তাদের যাতায়াতের কারণে ওপারের সীমান্ত মংডু থানা এলাকায় সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল কঠোর নিরাপত্তায়। কড়া নজরদারির কারণে ওপারের ইয়াবা মাফিয়ারা শতচেষ্টায়ও ওই দুই দিন ইয়াবার কোনো চালান বাংলাদেশে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছে হস্তান্তর করতে পারেনি। এতে মংডুর একটি মাদকের ডেরায় পড়ে থাকে ইয়াবার দুই দিনের চালান। কিন্তু বিপুল পরিমাণ এই চালান  মংডুতে পড়ে থাকার খবরটি চাউর হয়ে যায়। সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে দুই দিনের ইয়াবার চালান আটকে দেয়। হিসাব করে দেখা যায়, সেখানে প্রায় সোয়া দুই কোটি পিস ইয়াবা রয়েছে। কয়েক মণ ওজনের এই ইয়াবার চালানটি স্থল ও নৌপথে বাংলাদেশে পাচারের কথা ছিল। যা মিয়ানমারের গণমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ পায়। বিষয়টি বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও জানে।

মংডুতে ইয়াবার চালান আটকের মধ্য দিয়ে কী পরিমাণ ইয়াবা প্রতিদিন ঢুকছে বাংলাদেশে-তার একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসা ইয়াবার চালানের সঠিক কোনো তথ্য ছিল না, বা প্রকাশ হতো না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব সময় লাখের হিসাব করত। মংডুতে চালান আটকের পর এটা নিশ্চিত যে, লাখের হিসাব নয়, বাংলাদেশে এখন প্রতিদিনই ঢুকছে এক কোটির ওপর ইয়াবা।

মাদক পাচার ও রোধ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন এমন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারের রুট আর চালান দুটোই বেড়েছে। বিশেষ করে নৌপথ ব্যবহার করে ইয়াবার চালান বরিশাল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। যা আগে চিন্তাও করা যেত না। নৌপথ ব্যবহার করেই ইয়াবার চালান যাচ্ছে নাইক্ষ্যংছড়ি কিংবা বান্দরবানের পাহাড়ে। আবার ইয়াবা ভর্তি ট্রলার যাচ্ছে চট্টগ্রামের আনোয়ারায়।

টেকনাফ, উখিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন এসব তথ্যের মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ও কথা বলে জানা যায়, আগে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যেই তাদের তৎপরতা চালাত। গাড়ি নিয়ে তাদের ছোটাছুটি দেখলে বোঝা যায়, তারা ইয়াবা পাচারে ব্যস্ত রয়েছে। এখন টেকনাফে তাদের বি-গ্রুপ থাকে প্রকাশ্যে। শীর্ষ ব্যবসায়ীরা উখিয়া, কক্সবাজার, চট্টগ্রামে অবস্থান নিয়ে তাদের নেটওয়ার্ক সচল রাখে।স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মাফিয়াদের ইয়াবা সাম্রাজ্য হচ্ছে টেকনাফ। টেকনাফের ৩১২টি গ্রামের মধ্যে পৌনে তিনশ গ্রামেই রয়েছে ইয়াবার প্রভাব। ঘরে ঘরে ব্যবসায়ী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই টেকনাফকে মাফিয়ারা ইয়াবার নগরীতে পরিণত করেছে। টেকনাফের নদী, সাগর, পাহাড়-সবই তারা ব্যবহার করছে ইয়াবা ব্যবসায়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, টেকনাফের রাজনীতি, অর্থনীতি ইয়াবাকেন্দ্রিক। চাষযোগ্য ভূমিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ইয়াবার কারণে। কারণ সেখানে চাষিরা এখন আর কোনো চাষাবাদ করছে না। তারা চাষাবাদ ছেড়ে এখন ইয়াবা ব্যবসায়। সেখানকার আইন-কানুন সবই চলে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নির্দেশে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, জনপ্রতিনিধিদের ‘টপ-টু-বটম’ ইয়াবা ব্যবসায়ী। আর এই ইয়াবা ব্যবসায়ীরাই চালাচ্ছেন টেকনাফের প্রশাসন। সরকারি কর্মকর্তারাও চলছেন তাদের নির্দেশে। টেকনাফকে তারা গড়ে তুলেছেন ভিন্ন এক নগরীতে। প্রতিদিনই ইয়াবা ঢুকছে বিভিন্ন পথে। প্রতি পিস ইয়াবার জন্য পাঁচ টাকা করে কমিশন রাখেন টেকনাফের গডফাদার। আর ইয়াবা ব্যবসায়ী সবাইকে পুলিশ চেনে। কিন্তু তাদের গ্রেফতার করা হয় না। পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রতিটি সংস্থাই সেখানে জড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা ব্যবসায়।

টেকনাফের প্রাইমারি স্কুলের এক শিক্ষক জানান, টেকনাফকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলা হয়েছে। ইয়াবা এখানে প্রাতিষ্ঠানিক  রূপ পেয়েছে। সরকার ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকা করে। তিনি বলেন, এর চেয়ে ভালো যারা ব্যবসা করেন না, তাদের নামের তালিকা করলেই ভালো হয়। কারণ এখানে কেউ ইয়াবা ব্যবসায়ী ছাড়া নেই।গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সাগর সীমান্তে ইয়াবা তৈরির জন্য গড়ে উঠেছে ৪০টি কারখানা। আর  চট্টগ্রামের নৌপথে আসছে কোটি টাকার এসব ইয়াবা। পার হচ্ছে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে। পাচারকারীরা সুকৌশলে এ মাদক নিয়ে আসছে রাতের আঁধারে।জানা গেছে, টেকনাফ সীমান্তের পাশাপাশি এখন খাগড়াছড়ির গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা আসছে। অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে টেকনাফ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় ইয়াবার ছোট-বড় অসংখ্য কারখানা স্থাপিত হয়েছে।আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সড়কপথে পাচারের পাশাপাশি এখন ইয়াবার বড় বড় চালান আসছে সাগরপথে। চট্টগ্রামের সাগর উপকূলে প্রায়ই ধরা পড়ছে ইয়াবা। স্থল সীমান্তের পাশাপাশি গভীর সমুদ্র অঞ্চল হয়ে পাচার হচ্ছে ইয়াবা। স্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক কড়াকড়ির কারণে এখন সমুদ্র পথকে বেছে নিয়েছে পাচারকারীরা। এ পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় চালানগুলোর বেশির ভাগই সমুদ্র পথে নেওয়া হচ্ছে।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031