মার্কিন আইনসভা ভবন ক্যাপিটল হিলে কি ঘটেছিল বুধবার ?  ঘটনার নেপথ্যে কারা ? তাদের উদ্দেশ্যই কি? পরিকল্পনাই বা কি ছিল ? এমন নানা প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘটনার পর থেকে মার্কিন মিডিয়ায় এ নিয়ে চলছে নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। ৬ জানুয়ারি ইলেক্টোরাল ভোট সার্টিফিকেশন করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস। এটা কংগ্রেসের রূটিন কাজ। প্রতিটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর অর্থাৎ ৪ বছর পর পর  এইদিনেই কংগ্রেস ও সিনেটের যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয় ।

এবারের সভায় ঘটে এই ন্যাক্কারজনক সন্ত্রাসী ঘটনা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কয়েক ডজন মিথ্যা নির্বাচনী মামলায় হেরে যাওয়ার পর টেক্সাস অ্যাটর্নি জেনারেলকে দিয়ে মামলা দায়ের করে আমেরিকার সর্বোচ্চ  আদালতে যান।কিন্তু প্রেসিডেন্টের শেষ ভরসা সুপ্রিম কোর্টও এমন ভিত্তিহীন মামলা শুনতে কোন রকমের আগ্রহ দেখাননি। এরপর রাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোটের সার্টিফিকেশন আটকাতে মরণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন তিনি। এরপরেই মার্কিন গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যার শেষ প্লট রচিত হয়।

গত ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন ঘিরে ডাক দেয়া হয় সমাবেশ। ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে কংগ্রেসকে জিম্মি করে ইলেক্টোরাল ভোটের ফল পাল্টে দেয়ার ষড়যন্ত্র। আর এই সমাবেশ আহ্বান করা হয় ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে।এতে টেড ক্রুজ,জশ হাউলিসহ কিছু সিনেট ও কংগ্রেসের আইনপ্রণেতা মদত যোগান। সন্ত্রাসীরা ক্যাপিটল হিল আক্রমণ করার আগে সিনেটর জশ হাউলিকে ভবনের বাইরে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে সমর্থন জানাতে দেখা যায়।  উইমেন ফর আমেরিকা ফার্স্টের ব্যানারে এই সমাবেশ ডাকা হলেও মূলে রয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।  তার চরম ডানপন্হী শেতাঙ্গবাদী  প্রাউড বয়েজের মদত। এসব মিলিশিয়া গোষ্ঠীর অস্ত্র চালনাসহ সব প্রকারের সামরিক প্রশিক্ষণ রয়েছে। অবশ্য কতিপয় আইন প্রণেতা ছাড়া ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির সকল নেতাই প্রায় দুই মাস তাকে থামানোর কোন প্রয়াস না নিয়ে নীরবতা পালন করেন। ফলে ট্রাম্প ক্রমেই হয়ে ওঠেন বেপরোয়া।  সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সমাবেশের প্রচার চলে অত্যন্ত জোরেশোরে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একের পর এক উত্তেজক টুইট করে ভক্তদের চাঙ্গা করেন।

 

ডিসেম্বরের শেষ দিকে ট্রাম্প সমর্থকরা জড়ো হতে থাকে ওয়াশিংটনে।ডিসেম্বরের ৩১ তারিখের মধ্যেই মেট্রো ওয়াশিংটন এলাকার হোটেল মোটেল ট্রাম্পের এইসব ভক্ত সন্ত্রাসীদের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই কদিন ওয়াশিংটনে থেকে তারা ক্যাপিটল হিল ভবনের সবকিছু ভাল করেই আয়ত্ব করতে সক্ষম হয়। রেকি করে নেয় । বুধবার সমাবেশ শুরু হয়। হোয়াইট হাউসের সামনে বেলা ১২ টায় ট্রাম্প বক্তব্য রাখেন। তিনি ক্যাপিটল হিলে যাওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, আমিও তোমাদের সাথে যাব। দূর্বল রিপাবলিকানদের সাহায্য লাগতে পারে। কিন্তু তিনি এসব সন্ত্রাসীদের সাথে যাননি। এই বক্তব্যের পরই শান্তিপূর্ণ সমাবেশ রুদ্রমূর্তি ধারণ করে অনতিদূরে ক্যাপিটল ভবনের দিকে পদযাত্রা শুরু করে। ভবনের গোড়ায় পৌঁছে সন্ত্রাসীরা পুলিশের ব্যারিকেডের সন্মুখিন হয়। এখানে পুলিশের সাথে বচসা চলে কিছু সময়। তারপর শক্তি সঞ্চয় করে সন্ত্রাসীরা ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে। সন্ত্রাসীদের তুলনায় সংখ্যায় সীমিত পুলিশ তাদের সাথে পেরে ওঠেনি। তখন  বৃশংখল পরিস্হিতির সৃষ্টি হয় গোটা ক্যাপিটল ভবন এলাকায়।

বেলা ১ টা ৫৫ মিনিটঃ কেউ কেউ দেয়াল বেয়ে আবার কেউ পাহাড় ক্লাইমিংয়ের মতো রশি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। রশিসহ এসকল সরঞ্জাম সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সাথে করে নিয়ে  আসে। এতে ধারণা করা যায়, এই পরিকল্পনা  আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।

বেলা ২টা ৩০ মিনিটঃ সন্ত্রাসীরা ভবনে ঢুকে পড়ে। জনালার কাঁচ ভাঙচুর শুরু করে এবং ভবন লবি রুটান্ডায় চলে যায়। তখন নীরুপায় ক্যাপিটল পুলিশের চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। তারা অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে। ফ্লোরে তখন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের সভাপতিত্বে যৌথ সভা চলছিল এবং ট্রাম্পের পক্ষে মাত্র ১২টি ইলেক্টোরাল ভোট গোণা শেষ হয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষীরা ফ্লোরে উপস্হিত সকলকে আসনের নীচে থাকা গ্যাস মাক্স পরে নিতে বলে। হকচকিত হয়ে যান সকলেই। কেউ কেউ আসনের আড়াল নেন। কেউবা শুয়ে পড়েন ফ্লোরে। অসহায় পুলিশ তখন বিভিন্ন আসবাবপত্র দিয়ে দরজা ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা চালায়। উঁচিয়ে ধরে অস্ত্র। তাড়াতাড়ি সকলকে সুড়ঙ্গ পথে নিয়ে যাওয়া হয় আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাংকারের নিরাপদ আশ্রয়ে। ততক্ষণে পুরো ভবনের দখল নিয়ে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা। শুরু করে দিয়েছে তাণ্ডব, তাদের উল্লাস নৃত্য। স্পিকার পেলোসির অফিস,কংগ্রেস ও সিনেট ফ্লোর দখলে নিয়ে সন্ত্রাসী গৌষ্ঠী চালায় ব্যাপক অরাজকতা। করে মূল্যবান আসবাব ও কাগজপত্র তছনছ। শুরু করে লুটপাট। বিনষ্ট করে বহু সরকারি সম্পদ।

বিকাল ৪ টা: নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জাতীর উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেন,এটা আমাদের আমেরিকা নয়, যা দেখছেন। তিনি এর কঠোর নিন্দা জানান। জাতীয় টেলিভিশনে বক্তব্য দিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের  প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, ন্যাশনাল  টেলিভিশনে আসুন এসব সন্ত্রাসীদের এখনই তাণ্ডব বন্ধ করতে এবং ওয়াশিংটন ছেড়ে যেতে বলুন।

বিকাল ৪ টা ১৭ মিনিটঃ প্রেসিডেন্ট টাম্প এক সংক্ষিপ্ত ভিডিও বার্তায় আবার মিথ্যা ভোট জালিয়াতির কথা বলেন এবং সন্ত্রাসীদের ভেরি স্পেশাল হিসেবে উল্লখ করেন। তিনি শান্তির আহবান ও এদের ফিরে যেতে বললেও কোন নিন্দা জানাননি ক্যাপিটল হিল দখলের।

বিকেল ৫ টাঃ পার্শ্ববর্তী রাজ্য ম্যরিল্যান্ড,ভার্জিনিয়াসহ বিভিন্ন স্হান থেকে এসে পৌঁছায় ব্যাকআপ ফোর্স। তারপর শুরু হয় অপারেশন। ছোড়া হয় কাদানে গ্যাস ও পিপার স্প্রে। অনেককে করা হয় আটক। সন্ত্রাসী দখলদারদের হটিয়ে মুক্ত করা হয় ক্যাপিটল ভবন। সকল সন্ত্রাসীদের তাড়িয়ে দেয়া হয় ভবনের আঙিনা থেকে।

সন্ধ্যা ৬টাঃ ওয়াশিংটনে জারি করা হয় কারফিউ। রাতে ধীরে ধীরে ওয়াশিংটনের রাজপথ ছেড়ে যায় সন্ত্রাসীরা।

রাত ৮ টাঃ কংগ্রেসের সদস্যরা নিরাপদ স্হান থেকে বেড়িয়ে আসেন। শুরু হয় যৌথ অধিবেশন। এরপরও আ্যরিজোনা ও পেনসেলভেনিয়ার ইলেক্টোরাল ভোট নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করেন ৭ সিনেটরসহ কংগ্রেসের ১৪৭ জন সদস্য। কিন্তু ভোটে টিকেনি তাদের বাঁধা। রাত প্রায় ৪ টায় পাস হয় ইলেক্টোরাল ভোটের সার্টিফিকেশন। চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হিসাবে ঘোষণা করা হয় প্রেসিডেন্ট জোসেফ আর বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা ডি হ্যারিসকে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২০শে জানুয়ারি শপথ নেবেন।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031