স্কুল-কলেজের সামনে তাদের জটলা রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ নেতাকর্মীর অবস্থান। শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অংশ নিতে চাইলে তা প্রতিরোধ করা হয়। স্কুল থেকে বের হতে বাধা দেয়া হয়। কাউকে কাউকে জোর করে স্কুলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ছাত্রদের ওপর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং হামলার ঘটনাও ঘটেছে গতকাল।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের অষ্টম দিন রোববার রাজধানীজুড়ে দেখা গেছে এমন নানা চিত্র। তবে এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেয়। পালন করে তাদের আন্দোলনের ধারাবাহিক কর্মসূচি।

রাজধানীর অন্যতম প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী মোড়। বেলা ১১টা ৭ মিনিট। ফ্লাইওভারের নিচে অবস্থান নেন শতাধিক ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিকলীগ নেতাকর্মী। তাদের পাশে অবস্থান নেয় পুলিশের একটি টিম। তাদের অধিকাংশ বসে ছিলেন পেতে রাখা চেয়ারে। দৃষ্টি রাস্তায়। এরই মধ্যে দেখা যায় কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর আনাগোনা। ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থীর কয়েকটি টিম লেগুনা গাড়িতে চড়ে অতিক্রম করে ওই এলাকা। ছাত্রদের দেখে কেউ কেউ উস্কানিমূলক দু’এক কথা ছুড়ে দিলেও তাদেরই কয়েকজন নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তবে তাদের উপস্থিতির কারণে সেই এলাকায় ছাত্রদের অন্য দিনের মতো রাস্তায় যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে দেখা যায়নি।

সেখানে অবস্থান নেয়া একজন নিজেকে যুবলীগ কর্মী শাহেদুল ইসলাম পরিচয় দিয়ে বলেন, ট্রাফিকে শৃঙ্খলা আনা কী ছাত্রদের কাজ। তাই তারা এসব করতে চাইলে বাধা দেয়া হচ্ছে। কয়েকজন এদিকে এলেও আমাদের দেখে তারা আগের দিনের মতো গাড়ির লাইসেন্স দেখতে চায়নি।

যাত্রবাড়ী থেকে সায়েদাবাদ অভিমুখী এগুতেই যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। আগের দিন ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের পুরো এলাকায় অবস্থান নিয়ে যানবাহনের লাইসেন্স তল্লাশিসহ যানচলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে দেখা গেলেও গতকাল তাদের দেখা যায়নি। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রবেশ ফটকে অন্তত ৩০ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। তারা দাঁড়িয়ে গল্প-গুজবে মত্ত। কাছে গিয়ে তারা ছাত্র কিনা জানতে চাইতেই জানালেন ‘আমরা ছাত্রলীগ’। তাদের মধ্যে মো. রাসেল ও তুষার চৌধুরী দু’জনই স্থানীয় ৫০ নম্বর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী ওয়ার্ড ছাত্রলীগের বিগত দু’কমিটির সভাপতি ছিলেন বলে পরিচয় দিলেন। তারা বললেন, আমরা সকাল ৯টা থেকে এখানে অবস্থান নিয়েছি। কাউকে ধাওয়া দিইনি। তবে ছাত্রদের বোঝাচ্ছি, যাতে বিশৃঙ্খলা না করে ক্লাসে ঢুকে পড়ে। আজকে কাউকে রাস্তায় নামতে দিইনি। ওই স্কুলের দশম শ্রেণির মানবিক বিভাগের এক ছাত্র বলেন, আমরা গত কয়েকদিন আন্দোলন করি। আমাদের বিভাগে ৪২ জন ছাত্রের মধ্যে গতকাল ক্লাসে উপস্থিত ছিল মাত্র ৪ জন। স্কুলে এসে পরিস্থিতি দেখে ক্লাস না করেই বাসায় ফিরে যাচ্ছি।

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ও আশেপাশের রাস্তায় সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে আছে। কাউন্টারগুলোও বন্ধ। সেখানে একাধিক স্থানে জটলা করে বসে আছেন শ্রমিকরা। অলস সময় কাটাচ্ছেন তারা। অভিন্ন চিত্র দেখা গেছে মিরপুরেও। প্রতিদিনের মতো গতকালও মিরপুর এলাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করে। তাদের লক্ষ্য ছিল মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করা। তবে সকাল ১০টার আগেই মিরপুরের একাধিক পয়েন্টে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং শ্রমিকলীগের কর্মীরা। এ কারণে শিক্ষার্থীরা ফিরে যায়। অনেকে আবার আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের কর্মীর তৎপরতা দেখে সটকে পড়ে। এ কারণে বিগত কয়েক দিনের মতো মিরপুর এলাকায় শিক্ষার্থীদের জমায়েত হতে দেখা যায়নি। রোববার সকাল ১০টার আগেই মিরপুর এক নম্বরের সনি সিনেমা হলের সামনে অবস্থান নেন পরিবহন মালিক এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেন শ্রমিকলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কর্মী-সমর্থকরা। মিরপুরের ওই স্থানে কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে মিছিলে যোগ দেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য সাবিনা আক্তার তুহিন। মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদও নেতাকর্মীদের নিয়ে যোগ দেন। এ সময় মিরপুর এলাকায় গণপরিবহন চলতে দেখা যায়নি। তবে রিকশা, অটোরিকশাসহ প্রাইভেটকার চলতে দেখা গেছে। দুপুর ১২টার পরে এসব নেতাকর্মী ফের মিছিল করেন। সনি গোল চত্বর প্রদক্ষিণ করে মিরপুর এক নম্বর হয়ে মিছিল নিয়ে যান। এদিকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শতাধিক শিক্ষার্থীর একটি দল মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে ১০ নম্বরের দিকে মিছিল নিয়ে যেতে চাইলে তাদের ফায়ার সার্ভিসের গেটে আটকে দেয় ছাত্রলীগ। তারা আগে থেকেই গোল চত্বরের পুলিশ বক্সের কাছে অবস্থান করছিলেন। হেলমেট পরিহিত ছাত্রলীগের ১০ থেকে ১২ জন নেতাকর্মী এগিয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করে। চলে যেতে বলে। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীদের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘তোমরা আমাদের ভাই। বাসায় ফিরে যাও। আর সামনে এগুলে সড়কেই পড়ে যাবে’। এরপর শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে পেছন ফিরে চলে যায়। বিকাল ৪টা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা মিরপুর এলাকায় বিভিন্ন স্থানে অবস্থান এবং মিছিল করলেও হামলা বা সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়নি।
ধানমন্ডি ২৭-এ একাধিক স্কুল ও কলেজের সামনে গতকাল দুপুরে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অবস্থান নিতে দেখা যায়। ১টার পর মধ্যবাড্ডার লুৎফন টাওয়ারের সামনে জড়ো হন যুবলীগ কর্মীরা। এরপর তারা সেখানে ঝটিকা মিছিল করেন। বেশ কিছুক্ষণ অবস্থানের পর তারা ফিরে যান। এদিকে কাটাবন এবং এলিফ্যান্ট রোডেও গতকাল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিকলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অবস্থান নিতে দেখা গেছে।

কমলাপুর রেলস্টেশনে উপচেপড়া ভিড়, দীর্ঘ লাইন: ছাত্র আন্দোলন শুরুর পর চলছে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট। রাজধানীর সঙ্গে দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা শহরের পরিবহন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সপ্তাহজুড়ে ট্রেন ধরার জন্য রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে প্রচণ্ড ভিড় দেখা গেছে। গতকালও কমলাপুরে দেখা গেছে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। শুধু একটি টিকিটের জন্য সবার দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও টিকিট না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেকে। কেউ কেউ টিকিট পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও অধিকাংশই ফিরছিলেন হতাশ হয়ে।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার একটি টিকিটের জন্য কমলাপুর রেল স্টেশনে আসা কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উদ্ভিদ কর্মকর্তা মহি উদ্দিন বলেন, অফিসের কাজে ঢাকায় এসে আটকা পড়েছি। অন্যদিকে আমার কর্মরত উপজেলায় কৃষি মেলা আয়োজনের প্রস্তুতির কাজ পড়ে আছে। অন্তত ট্রেনে যাওয়ার চেষ্টা করতে এসে দেখি মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। টিকিট পাওয়ার আশাই ছেড়ে দিয়েছি। কমলাপুরের রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার সিতাংশু চক্রবর্তী মানবজমিনকে বলেন, বাস চলাচল বন্ধ হওয়ার পর থেকে রেলে ভিড় বাড়ছে। দিন দিন তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ট্রেনের সঙ্গে দু’একটি অতিরিক্ত বগি সংযোজন করে কিছু বাড়তি যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। তার পরও সিংহভাগ যাত্রীই দীর্ঘ লাইনে প্রতীক্ষার পর টিকিট না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরছেন।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031