হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে– ‘কখন আসবে কবি?’ কখন আসবে কবি?’- কবি এসেছিলেন, লিখেছিলেন তার অমর কবিতাখানি। তিনি আর কেউ নন,আমাদের দুর্ভাগ্য, মানবতার সেই মুক্তির দূতকে সপরিবারে হত্যা করেছে এ জাতিরই কিছু কুসন্তান, যারা এ হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সকল অর্জনকে। ঘাতকের লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তের কোনো উত্তরাধিকার যেন বেঁচে না থাকে। আর সেজন্যই তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ১০ বছরের শিশু রাসেলকেও রেহাই দেয়নি তারা। কিন্তু তাদের সেই প্রাণপণ চেষ্টা সফল হয় নি। জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু আরো বেশি জীবন্ত হয়ে প্রতিনিয়ত প্রেরণা যুগিয়ে চলেছে বাঙালি মননে। তাইতো স্বাধীন বাংলদেশের স্থপতি, স্বয়ম্ভর বাংলাদেশ গঠনের স্বাপ্নিক পুরুষ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল, তারা হারিয়েছে কালের গর্ভে; নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।

শোকের মাস আগস্ট। আজ তাই শোককে শক্তিতে রূপান্তরের মাসও বটে। সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে বঙ্গবন্ধুর চেতনা আজ তাই জাতীয় ঐক্য ও চেতনার প্রতীক। আশার কথা হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও বঙ্গবন্ধু ও তার কর্মযজ্ঞ পূর্ণ অবয়বে উদ্ভাসিত। এ সাফল্যের রূপকার নিঃসন্দেহে তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন প্রজন্মের কাছে আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা মহান পুরুষ। জাতীয় শোক দিবসে গতকাল তাই আবালবৃদ্ধবনিতা বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘সেই জাতিই ভাগ্যবান, যার নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণার রসদ খুঁজে পায়।’ কিন্তু আমাদের বড়ই দুর্ভাগ্য, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহত্তম অর্জন এবং সেই অর্জনের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এক সময় একদল জ্ঞানপাপী অযথা কুর্তক করে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করেছিল। দুঃখের বিষয়, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই অপকর্ম করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে ইতিহাস তার আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও তার মূল প্রেরণার উৎস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধীরে ধীরে স্বমহীমায় অধিষ্ঠিত হতে দেখে আমাদের নতুন প্রজন্ম এখন অনেকটা আশ্বস্থ। দলমত নির্বিশেষে তিনি বাঙালি জাতির সবচেয়ে উজ্জ্বল আইকন হিসেবে দিন দিন আরো প্রবল হচ্ছেন। সে কারণে তাদের বিভ্রান্তি কেটে যাচ্ছে। অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে নিয়ে তাই তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। উন্নত বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে শামিল হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু আজ মিশে আছেন প্রতিটি বাঙালির মনে। সেই কলঙ্কিত ’৭৫–এর অনেক পরে যাদের জন্ম, তাদের কাছেও আজ বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। তিনি কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর নয়, তিনি ১৬ কোটি বাঙালির আত্মার আত্মীয়, তিনি সমগ্র বিশ্বের, তিনি সকল অবহেলিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের। যে বঙ্গবন্ধুকে ওরা হত্যা করেছে সেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। সেই বঙ্গবন্ধু এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক। প্রতীক বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের। সেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের প্রতীক।

কলেজ ছাত্রী মুনিরা তাবাস্‌সুমের ভাষায়, ‘আমরা আধুনিকতার যুগে বাস করছি, এটা আমাদের সৌভাগ্য। তাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জানার সুযোগটা পাচ্ছি বেশি। তবে তাঁর কর্মযজ্ঞ নিয়ে আরো বেশি কাজ হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বর্তমানে এদেশের প্রধানমন্ত্রী। এখনই সুযোগ। শুধু ১৭ মার্চ কিংবা ১৫ আগস্টে তাকে বেঁধে না রেখে যতো বেশি ছড়িয়ে দেওয়া যাবে, ততই তাঁর সম্পর্কে আরো বেশি করে জানার সুযোগ সৃষ্টি হবে।’

স্কুল শিক্ষার্থী শান্ত জানায়, ‘পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখা পড়েছি। স্কুলে একবার ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছি। আমাদের শিক্ষকরা ক্লাসেও বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেন। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর জীবনের ওপর বই পুরস্কার দেওয়া হয়। এটা আমাদের বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে সহায়তা করে।’

স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রায় সকলেই আজাদীকে জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাঁরা প্রথম জেনেছে তাদের মা–বাবা থেকে। শিশুদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে অনুকরণ করার প্রবণতাও বাড়ছে। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে ‘বাঙালির বাংলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।’ এজন্য নজরুল একটি সোনার ছেলে ভিক্ষা চেয়েছিলেন। যে বলবে, ‘আমি ঘরের নই, আমি পরের। আমি আমার নই, আমি দেশের।’ বাঙালি জাতির পরম সৌভাগ্য এমন একটি ‘সোনার ছেলে’ জন্মেছিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। যে ছেলেটি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতেও পিছ–পা হননি। শেখ মুজিবুর রহমান নামের সেই ‘সোনার ছেলে’র কল্যাণেই ‘বাঙালির বাংলা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর সেই ‘সোনার ছেলে’টি হয়ে উঠেছেন বাঙালি জাতির পিতা।

স্কুল পড়ুয়া ফুটবল পাগল দূরন্ত শেখ মুজিব (ডাক নাম খোকা)। টুঙ্গিপাড়ায় খোকা যে স্কুলে পড়তেন একদিন সেই স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে.এম ফজলুল হক। ঐ দূরন্ত খোকাটি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন স্কুল ঘরের দূরাবস্থার কথা এবং এর সমাধান না করলে শেরে বাংলাকে ঘেরাও করে রাখা হবে। এই প্রথম শেরে বাংলা খোকার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, বাহ ছেলেটি তো বেশ সাহসী। তোমার কথায় আমি দাবি মেনে নিলাম। এই খোকাটিই হলেন ইতিহাসের রাখাল রাজা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আজকের প্রতিটি শিশু কিশোরকে সেদিনের খোকাটির মতই সাহসে ও সততায় বলীয়ান হতে হবে। আজকে গভীর শোকের এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক শোককে শক্তিতে পরিণত করে উন্নয়নের ধারা আরো বেগবান করা। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য সোনার বাংলার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবেই।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031