নিজের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে আছি। সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। আগে অফিস থাকায় দিন শেষে আর কিছু না হলেও অন্তত অফিসিয়াল কাজগুলো হতো! নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো একটা জায়গা থাকত। এই যে ছুটি শুরু হওয়ার সময় ভাবলাম এই ছুটিতে একটা উপন্যাস অন্তত লিখে শেষ করব। শেষ করা তো দূরস্থান, উপন্যাসের নামে একটা লাইন পর্যন্ত লিখতে পারলাম না! কবিতা? না, কোনো কবিতাও লিখতে পারি নাই। কিছু মুভি অবশ্য দেখা হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ কী! একমাত্র ‘রেনোয়ার’ দেখার পরেই বুকের ভেতর একটা মুক্তির সুবাস পেয়েছিলাম। ট্যাবু থেকে বের হয়ে একটা স্বাধীন মানুষ হয়ে উঠেছিলাম ওই মুহূর্তে। বাকিগুলো দেখলাম বটে, নিতে পারলাম কই! মুভি দেখে লেখক হিসেবে সেখান থেকে কিছু নিতে না পারলে আর লাভ কী! কোন পরিচালক কোন অ্যাঙ্গেলে ছবিটা বানালেন, কোন অভিনয়শিল্পী কেমন অভিনয় করলেন, কোন সিনেমাটোগ্রাফি কেমন— এ সবই অন্যদের কাজ। সেখান থেকে হয়তো মনের ভেতর একটা ফ্রেম তৈরি হয় কিন্তু লেখার রসদ কই? ফটোগ্রাফির যেহেতু অভ্যাস আছে, সিনেমাটোগ্রাফিগুলো হয়তো কাজে আসবে। কিন্তু গল্প বা উপন্যাসের প্লট? পুরো সময়ের অবাধ অপচয় হলো।

এই যে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই কম্পিউটার ছেড়ে বসে আছি, আশা যে, কিছু একটা লিখে শেষ করব। কিন্তু লেখা তো আসছে না। কী লিখব? কীভাবে লিখব? পড়তে গেলাম গত কয়েক দিন। ওয়াসি অহমেদের গল্পসংগ্রহ, মার্কেসের আত্মজীবনী ‘বেঁচে আছি গল্পটা বলব বলে’, মনীন্দ্র গুপ্তর ‘অক্ষয় মালবেরি’, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়… না, মন বসাতে পারছি না। প্রথম দিন জাহেদ মোতালেবের ‘ধানশি’ পড়তে শুরু করেছিলাম। চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে রেখে দিয়েছি। লেখকের দোষ দিচ্ছি না। হয়তো আমিই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। পড়ার জন্য যে ধৈর্যের প্রয়োজন হয়, তা এই সস্তা বিনোদনের জগতে পড়তে যাওয়া একটা পরিশ্রমই বটে! কে আর এই পরিশ্রমটুকু করতে চায়! অবচেতনের এই ভাবনা, এই আলস্যটুকুর কারণেই মেবি আমার কিছু হচ্ছে না। ‘হচ্ছে না, হচ্ছে না’ শুনে আমার সাইকিয়াট্রিস্ট একদিন বলছিলেন, ‘হচ্ছে না হচ্ছে না করেও তো তিনটে বই লিখে ফেলেছেন, শ তিনেক প্রচ্ছদ করে ফেলেছেন, বাইরের একটা দেশ থেকে একটা সম্মাননা অর্জন করেছেন, দেশে এবং দেশের বাইরের অন্তত হাজার দশেক মানুষ আপনার নাম জানে। তো হচ্ছে না বলছেন কেন?’

আমি বলেছিলাম, ‘ঠিক যেভাবে কাজটা করতে চাই, যে ডেডিকেশন, যে উচ্চতায় পৌঁছে কথা বলতে চাই তা তো পারছি না।’ তিনি শুনে মুচকি মুচকি হাসছিলেন। এমনিতে রাশভারি মানুষ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রসের ডিব্বা! আমি যখন আমার ট্রমাগুলো বলতে থাকি, তিনি বিনাবাক্যে শুনতে থাকেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, লোকটা সত্যিই শুনছেন তো! আমার সন্দেহ দূর করতেই কিনা কোনো কোনো পয়েন্টে তিনি ডিটেইল আলোচনা করেন। সেদিন সিলভীর কথা বলতে গিয়ে আমি রীতিমতো সংকোচে অপরাধবোধে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। তিনি মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলছিলেন, ‘প্রেমকে আপনার অপরাধ মনে হয়?’ আমি কলাপাতার মতো মাথা দুদিকে দুলিয়ে বলেছিলাম, ‘না। কিন্তু অবৈধ প্রেম?’

‘প্রেম আবার অবৈধ হয় কীভাবে?’

‘ধরেন এই যে যৌনাকাঙ্ক্ষা থেকে যে প্রেমগুলোর সূত্রপাত, বা, যৌনতাই যে প্রেমের মূল ভিত্তি কিন্তু প্রকাশ্যে প্লেটোনিক লাভের ছদ্মাবরণ থাকে, তাকে তো অবৈধই বলব? বলব না?’

‘যৌনতাকে আপনি অস্বীকার করতে চান?’

‘না, কিন্তু তার জন্য মিথ্যের, প্রেমের লেবাস নিতে হবে কেন? এটা তো অপরাধ।’

‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, যৌনতার মাঝে প্রেম থাকে না? বা, দুটো শরীর যখন একত্র হয় তখন কোনো আকর্ষণ ছাড়াই একত্র হয়? মানে, আপনি বলতে চাইছেন দুটো শরীর শুধুমাত্র মিথ্যের ছলনায় ভুলে প্রেমহীনভাবে মিলিত হয়?’

আমি আর কোনো উত্তর দিতে পারি নাই। তিনি মুচকি হেসে ঘটনার পরবর্তী প্রবাহে চলে যেতে বলেছিলেন।

২.

আমি বুঝতে পারছি, এই যে লিখে যাচ্ছি এ কেবলই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়া যে কিছু একটা লিখেছি। কিন্তু আমি এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি এটা কোনো গল্প বা উপন্যাস হচ্ছে না। আত্মজীবনীও নয়। আত্মজীবনীতে মিথ্যে থাকে না। কিন্তু আমি এখানে অনেকগুলো মিথ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছি। মিথ্যেটা লেখা আমার উদ্দিষ্ট ছিল না যদিও। চেয়েছিলাম গল্প বা উপন্যাস যেহেতু হচ্ছে না, আমি অন্তত আজকের ডায়েরিটা লিখি। কিন্তু লিখতে লিখতে লোভটা আর আটকে রাখতে পারলাম না। দেখলাম অনেকগুলো ওয়ার্ড লেখা হয়ে গেছে। একটাকেই যদি একটা গল্পের শেপ দেয়া যায়!

সিলভীর সাথে আমার প্রেমটাও ছিল এমন। সত্য সত্য চলতে চলতে তার মধ্যে মিথ্যে ঢুকে গিয়েছিল। দিনে দিনে সেই মিথ্যে আচরণগুলো, সেই মিথ্যে অভিনয়গুলোই আমার জীবনে সত্য হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। একটা বনসাই হয়ে উঠেছিলাম দিনে দিনে। এই যে আমি হীনম্মন্যতায় ভোগা ভীতু প্রকৃতির একজন মানুষ, অথরিটি পার্সোনে আমার জড়তা, সব সময় ‘আমি ঠিক নাই’ ভাবা, বা, এই যে আমাকে কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সঙ্গে সঙ্গে সে আমার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে ওঠে, আর আমি তার মনোযোগ আকর্ষণের ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে অবচেতনেই অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকি— এসবই তৈরি হয়েছে আসলে সিলভীর সাথে প্রেমের সময়কালে। কাছাকাছি বয়সের হওয়া সত্ত্বেও, যেহেতু তার একটা সংসার ছিল, ফলে প্রকাশ্যে সে ছিল আমার বড়োর ভূমিকায়। আর গোপনে গোপনে প্রেমিকা। ফলে সকলের সামনে আমাকে ছোটোর আচরণ করে যেতে হতো। এই ছোটোর অভিনয় করতে করতে আমি বড়ো হতে ভুলে গেলাম। ফলে তার বয়স থেকে উপরের বয়সের সকলেই আমার অথরিটি পার্সোনে পরিণত হয়ে উঠল, যা এখনো আমি বয়ে বেড়াচ্ছি।— এ সকলই আমি জেনেছি আমার সাইকিয়াট্রিস্টের কাছ থেকে। আমার এই জীবনটা আর ভালো লাগে না শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘কেমন জীবন আশা করেন?’ তখন কোনো উত্তর আমার তৈরি ছিল না। পরে বাসায় এসে এর উত্তর খুঁজেছিলাম। একটা নোট নিয়েছিলাম পরের কিছুদিন ধরে। এগুলো করেছিলাম মূলত পরবর্তী সেশনে তাকে শোনানোর জন্য। গল্প কিংবা উপন্যাসে হয়তো এসব চলে না কিন্তু একটা আধা-মিথ্যে রচনায় এসব নোট রাখতে তো আর দোষ নেই! নোটটা থাকুক।

“ডাক্তার সাহেব, নির্ভাবনায় থাকতে পারাটা হয়ত দারুণ কিছু। কিন্তু সেভাবে পেরে উঠছি কই?

এলোমেলো ভাবনা এসে সকালটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। একটা চাপ, একটা অপরাধবোধ এসে ভর করছে। অথচ এই সকালটাকে একান্ত নিজের করে নিতে চাইছি আমি।

কেন এমন হয়? কেন মানুষ কেবল সফল হবার জন্য জন্মায় না? আপনি বলেছেন, পরিস্থিতিকে পরিস্থিতির মতো থাকতে দিতে। বলেছিলেন, সমস্যা না থাকলে সমাধানের আর আনন্দ কই! আমি বোধ হয় আমার স্বাভাবিকতার জন্য ছটফট করছি। আমি বোধ হয় খুব ভেতরে ভেতরে কোথাও আগেই হেরে গিয়ে থাকি।

এই যে আমার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ভালোভাবে ডিল করতে পারি না এবং আমার অধিকারের বিষয়ে খুব হীনমন্ম্যতায় ভুগি, এটা কেন? আপনি সেদিন বলছিলেন প্রেম অবৈধ হয় না। কিন্তু যে প্রেম মানুষকে হীনমন্ম্য করে গড়ে তোলে তা প্রেম কী করে হয়? প্রেম তো মানুষকে সাহসী করে জানি। এই যে এখন আর কোনো কিছু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চাইতে পারি না। চাইতে গেলে খুবই চাপ অনুভব করি— এটা এলো কোত্থেকে? এই যে আজ আমার প্রাপ্য কিছু চাইতে গেলেও আমার ভেতরে একটা চোর চোর ভাব ফুটে ওঠে, ব্যক্তিত্ব মাঠে মারা যায়, অথচ আমি তো প্রকৃতই এমন নই। খুব, খুব হতাশ লাগে। আমার এই আমিটা কবে কখন তৈরি হলো ভেতরে ভেতরে?

আমার খুব কান্না পাচ্ছে এখন। আমার আর লিখতে ইচ্ছে করছে না।

*

আমি আমার মতো করে চলতে পারছি না— এটাই হয়ত আমার এই উদ্বিগ্নতার মূল কারণ। কেন আমি আমার মতো করে চলতে পারি না? কেন এতো সাত-পাঁচ ভেবে আমার স্বাভাবিকতাকে নষ্ট করি? অপরাধবোধে ভুগি? কেন এতো ভয় আমার? বৈধতার বাউন্ডারি আসলে কতটুকু, ডাক্তার সাহেব?

আপনি বলেছিলেন কেমন জীবন আশা করি— এক. একজন সাহসী, দৃঢ়তা সম্পন্ন আত্মবিশ্বাসী মানুষের জীবন। সাহসী মানুষ বলতে যে মানুষ দৃঢ়তার সঙ্গে ঘটনা বা কাজের প্রাসঙ্গিকতা বুঝে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। যে মানুষ কৃত কর্মের জন্য অনুতপ্ত হবে না। প্রয়োজনে ‘না’ বলতে পারবে। এবং এই ‘না’ বলা নিয়ে অহেতুক ভীতও হবে না। দুই. পার্সোনাল এথিকস আর সোসাল এথিকস এক করে ফেলবে না।”

পরের সেশনে এটা আর শোনানো হয় নাই। সিলভীর প্রসঙ্গে আমরা আরো জটিল বিশ্লেষণে গিয়েছিলাম সেদিন। কেন সেই রাতে সিলভীর ঘরে আমি গিয়েছিলাম— সেই ঘটনাটা তাকে বলা খুবই জরুরি ছিল। তার চেম্বারে যেতে যেতেই মনে হয়েছিল নোটের চাইতেও এই ঘটনা জানানো বেশি জরুরি। হয়তো এই ঘটনার ভেতরে আমার ভয়ের উৎস লুকানো আছে! কত কী-ই যে মনে হয় তার কাছে যাওয়ার সময়!

সিলভীই সেদিন ডেকেছিল। বলেছিল বাসায় কেউ নাই। রাতে এখানেই থেকে যেতে পারবে। আমি ভয়ে সংকুচিত হতে হতে বিষের উত্তেজনায় ফের সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। সমস্ত রাত ওদের বাসায় আমরা এক এক করে ফুলের মালা গেঁথেছিলাম। শেষ রাতের দিকে সাইকেলের আওয়াজে আমাদের সম্বিত ফিরে আসে। আমরা আবিষ্কার করি মালা নয় রাতভর আমরা একটা সাপ নিয়ে খেলেছি। সেই সাপটা ছোবল দেয়ার জন্য ফণা উঁচিয়ে ছুটে আসছে। আমাদের দুজনের মুখই শঙ্কায় আর উদ্বিগ্নতায় নীল হয়ে গিয়েছিল। কী করা উচিত বুঝে ওঠার আগেই সিলভী আমাকে লুকিয়ে ফেলেছিল। আর সিনেমায় দেখা পাকা বেদেনিদের মতো নেচে-গেয়ে সেই সাপকে বশ মানিয়ে বাক্সে বন্দি করেছিল লুকানো আমার সামনেই। ফেরার সময় শরীরে আর বল পাচ্ছিলাম না। যেন জীবনকে জুয়ার আসরে বাজি রেখে হেরে যেতে যেতে হঠাৎ জিতে যাওয়া একজন মানুষ ফিরে আসছে গন্তব্যহীনতার দিকে। তার আজ আর কোনো অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই। বর্তমানটা সে বুঝে উঠতে পারছে না। কেবল ফিরে আসছে। ফিরে আসছে… নিজেরই মিথ্যের ভেতর বড়ো হতে থাকা ট্রমাগুলোর দিকে। যেখানে সিলভী নামে কেউ কোনোদিনই ছিল না।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031