মর্জি হলেই ঢেলে দিচ্ছে অঝোর ধারায়। সাথে আছে জোয়ারের পানি। আকাশের নিত্যসঙ্গী এখন কালো মেঘ। দুটোর সম্মিলনে গত কয়েক দিন ধরেই প্লাবিত হয়েছে নগরীর বেশিরভাগ এলাকা। গতকাল মঙ্গলবারও আগ্রাবাদ, চাক্তাই–খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা পানিবন্দি ছিলেন। দুর্ভোগ–ভোগান্তির চরমে পৌঁছে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন ওইসব এলাকার লোকজন। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘ দিন ধরেই অসহায় নগরবাসী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। পেয়েছিলেন প্রতিশ্রুতিও। কিন্তু তার শতভাগ পূরণ হয়নি। ফলে দুর্ভোগ পিছু ছাড়েনি তাদের। অসহায় লোকগুলোর এমন করুণ অবস্থার সাথেই যেন মিলে যাচ্ছে ভূপেন হাজারিকার গাওয়া সেই বিখ্যাত গান ‘মেঘ থম থম করে কেউ নেই নেই…’

পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, আগের দিনের তুলনায় গতকাল বৃষ্টি কম রেকর্ড করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ৮৮ দশমিক ০২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে; যা আগের দিন ছিল ২২৫ মিলিমিটার। আবহাওয়া অফিসের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, মৌসুমী বায়ু উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় আছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় গভীর সঞ্চালণশীল মেঘমালার সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের উপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

এদিকে বৃষ্টিপাত কম হলেও গতকাল জোয়ারের পানিতে বেশ কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। গতকাল দুপুরে আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, বেপারিপাড়া, রঙ্গীপাড়া, মুহুরীপাড়া, ছোটপুল এলাকার কোথাও হাঁটু সমান, আবার কোথাও কোমর সমান পানি দেখা গেছে। এসব এলাকার লোকজন জানান, অল্প বৃষ্টি হলেও তারা পানিবন্দি হয়ে পড়েন। গত কয়েক দিন ধরে টানা ও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে পানি ছিল সেখানে। ওসব এলাকার বিভিন্ন বাসা–বাড়ি এবং দোকানেও পানি ঢোকেছে। পানি উঠেছে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালেও। গতকাল দুপুরে হাসপাতালটির নিচতলায় হাঁটু সমান পানি দেখা গেছে। এতে হাসপাতালটিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। হাসপতালটির কর্মকর্তা–কর্মচারীরা জানান, জোয়ারের সময়ও হাসপাতালের নিচতলায় পানি ঢুকে যায়। হাসপাতালের নিচতলা এখন প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

করিম নামে এক পথচারী দৈনিক আজাদীকে বলেন, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, সিজিএস সরকারি কলোনি, বহুতলা কলোনি, সোনালী ব্যাংক অফিসার্স কলোনিসহ আশপাশের এলাকাগুলো থেকে গত দুদিন ধরে পানি নামছে না। পানি না নামায় তাদের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে।

স্বরূপ দত্ত রাজু জানান, বিমানবন্দর সড়কের সিমেন্ট ক্রসিং থেকে নৌবাহিনী গেট পর্যন্ত এলাকায়ও পানি ছিল। মূল সড়কের আশপাশের কয়েকটি এলাকায়ও গত কয়েক দিন ধরে পানি ছিল।

এদিকে জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চাক্তাই–খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। গতকাল দুপুরে এবং মধ্যরাতে চাক্তাই–খাতুনগঞ্জে হাঁটু সমান পানি ছিল। ব্যবসায়ীরা জানান, জোয়ারের প্রভাবেই পানি উঠেছে। সেখানকার বিভিন্ন ব্যবসা–প্রতিষ্ঠানের দরজায় সিমেন্ট দিয়ে উঁচু করা হয়েছে; যাতে প্রতিষ্ঠানে পানি না ঢোকে। তবু কিছু কিছু দোকানে পানি ঢোকেছে।

চাক্তাই–খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি সোলায়মান বাদশা দৈনিক আজাদীকে বলেন, চাক্তাই–খাতুনগঞ্জের সড়কগুলোতে এক হাঁটু সমান পানি ছিল। অধিকাংশ দোকানের প্রবেশপথে প্রতিরক্ষা বাঁধ থাকায় পানি তেমন প্রবেশ করতে পারেনি। তবে অনেক ব্যবসা–প্রতিষ্ঠানে পানি ঢোকেছে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

চাক্তাই–খাতুনগঞ্জে জলাবদ্ধতা কতক্ষণ ধরে স্থায়ী ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ছিল। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমরা খাল খনন, নালা–নর্দমা পরিষ্কারের কথা বলে আসছি। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন ও সিডিএর মধ্যে ‘দোটানা’ থাকায় এবার কাজ হয়নি। এর মাশুল গুণতে হচ্ছে সাধারণ লোকজনকে। তিনি বলেন, ওয়াসা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ফলে বালি, ইট–পাথর নালা–খালে এসে পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এগুলো পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

গতকাল দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত চকবাজার ধোনিরপুল এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। সকালে প্রায় কোমর সমান পানি ছিল। বিকালে দেখা গেছে হাঁটু সমান। কাঁচাবাজারেও ছিল হাঁটু সমান পানি। জোয়ারের সময় বৃষ্টি হলে পানির মাত্রা বেড়ে যায় বলে জানান শফিক নামে এক সবজি বিক্রেতা। বাদুরতলাসহ আশপাশের এলাকার লোকজন জানান, তারা গত তিন দিন ধরে পানিবন্দি। ওসব এলাকার বিভিন্ন সড়ক ও অলি–গলিতে গতকাল পানি দেখা গেছে। সেখানকার বিভিন্ন বাসা–বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকে গেছে। শাকিল নামে বাদুরতলার এক বাসিন্দা জানান, বাসার ভেতর পানি ঢুকে গেছে।

এদিকে বাকলিয়া, কালামিয়া বাজার, কোরবানিগঞ্জ, মিয়াখান নগর, কাতালগঞ্জ, ওয়াসার মোড়, জিইসির মোড়, শুলকবহর, প্রবর্তক মোড়, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও এলাকায়ও বৃষ্টির সময় জলজট দেখা দেয়। বাসিন্দারা মারাত্মক দুর্ভোগে পড়েছেন। এদিকে জলাবদ্ধতার কারণে বহদ্দারহাটের পুকুর পাড়ে একটি রিকশা উল্টে এক যাত্রী সামান্য আহত হন বলে প্রত্য দর্শীরা জানান।

মেয়রের চীন সফর বাতিল

জলাবদ্ধতায় নগরবাসীর পাশে থাকার প্রত্যয়ে পূর্ব নির্ধারিত চীন সফর বাতিল করেছেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। আজ বুধবার চীনের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ত্যাগ করার ছিল মেয়রের। চীনে ডেলিগেটদের সাথে বৈঠক, কুনমিং বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন, কুনমিং মিউনিসিপালে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে ১৭ জুন দেশে ফেরার সিডিউল ছিল।

এ বিষয়ে মেয়র বলেন, নগরের ন্নিাঞ্চলে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সাধারণ মানুষজন কষ্ট পাচ্ছেন। এ অবস্থায় আমি কীভাবে চীন সফর করব? নগরবাসীর যেকোনো দুর্যোগ ও সহযোগিতায় পাশে থাকার জন্যই সফর বাতিল করা হয়েছে।

এদিকে গতকাল সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম চাক্তাই খাল সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত নগরবাসীর খোঁজখবর নেন।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031