আবার যেন সাম্প্রতিক অতীতের নৈরাজ্যে ফিরে গেছে বাংলাদেশ। মানুষের মনে আতঙ্ক, উদ্বেগ। সারাদেশের সাথে রাজধানীর যোগাযোগ ছিন্ন। বাস চলেনা। রাস্তায় রাস্তায় কর্মজীবী মানুষের ঢল। ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালে যেমন ছিল বাংলাদেশ। অফিস, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া অনিশ্চিত। অবরোধকারীদের হামলায়, পাথর/ইটের আঘাতে এই বুঝি চোখ গেল, মাথা ফাটল! এই বুঝি পেট্রোল বোমা পড়ল বাস, প্রাইভেট কারে। এই বুঝি ঝলসে গেল জীবন্ত মানুষ! অথচ সেদিনের ২০১৬ সালটাই তো ছিল কত ভিন্ন, কত শান্তির! সরকার ও জনগণ মিলে কী দারুণভাবেই না দেশে হরতাল-অবরোধের নৈরাজ্যকর সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্ত করে দিয়েছিলেন।

শ্রমিকদের কথা কী বলব? ‘সাম্যবাদ’, ‘সমাজতন্ত্র’ এর মত মহান সব ধারণার বাংলাদেশি ‘ধারক’বৃন্দ এখনো ‘হরতাল’ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারলেন না। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলন করছেন ভালো কথা। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আপনারা আন্দোলন না করলে কারা করবে? যারা পুঁজিবাদী, মুনাফালোভী এরা তো এসব আন্দোলন করবেনা। বামপন্থীরাই করবেন স্বাভাবিক। কিন্তু হরতাল কেন? আপনাদের হরতাল কেউ পালনও করেনা। বিএনপি-জামায়াতের হরতালই মানুষ এখন মানে না। সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তো সবার আগে সাধারণ মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। টিএসসি থেকে শাহবাগ আর প্রেসক্লাব থেকে হাইকোর্ট, এ পর্যন্ত ‘হরতাল’ করলেই কি গ্যাসের দাম কমাবে ‘পুঁজিবাদী’, ‘বুর্জোয়া’ সরকার? পারলে লাখ লাখ মানুষ নিয়ে মানববন্ধন করুন। কোটি কোটি মানুষের গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করুন। প্রতিবাদ হিসেবে মানুষকে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াতে আহ্বান করুন। কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই হরতাল। এর মধ্যেই ‘অশিক্ষিত’ গণপরিবহন শ্রমিকরা পুরো দেশ অচল করে দিল। রাজধানী ঢাকার সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বাংলাদেশ! কেউ কল্পনাও করেনি, এই সময় বাংলাদেশকে এভাবে কেউ থামিয়ে দিতে পারে! ধর্মঘট ডাকার কারণ নিয়ে ভাবলে আতঙ্ক বেড়ে যায় বহুগুণ। হত্যা মামলার রায়ে দুইজন চালক দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। আদালতের রায় বদলাতে হবে! আদালত মানেন না এসব শ্রমিক। আদালত হল রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ। আদালতকে চ্যালেঞ্জ করা মানে তো রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা।

এখন প্রশ্ন হলো, সামান্য বাসের হেলপার, চালকদের পক্ষে কি রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থাকে এত বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া সম্ভব? তাহলে এতবড় সাহস কিংবা দুঃসাহস এই শ্রমিকরা কোথায় পেল? কে তাদের সাহস যুগিয়েছে? কে তাদের বলল, ‘তোরা সব অচল করে দে’।

আসল উদ্দেশ্য কী ছিল দুদিনের এই নৈরাজ্যের? চালকদের নাকি ‘নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করতে এই ধর্মঘট! আদালত কী তাহলে এখন শ্রমিকদের জন্য অনিরাপদ হয়ে গেছে? কত বড় ধৃষ্টতা! সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের বাসায় বসে নাকি পুরো দেশ অচল করে আদালতকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য করার কৌশল বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সারা দেশের শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষ ফোরাম বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি হলেন আওয়ামী লীগ সরকারের নৌমন্ত্রী শাজাহান খান।

সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী সোমবার রাতে সরকারের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি ও স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ কমপক্ষে ৫০ জন মালিক-শ্রমিকনেতা উপস্থিত ছিলেন। এই মালিক-শ্রমিক নেতারা নিশ্চয় বিএনপি-জামায়াতের কেউ না। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের পরিচয়েই তারা ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা ধান্দা-ফিকির চালিয়ে যাচ্ছেন।

তাহলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী হয়ে কীভাবে দেশের সাধারণ মানুষকে এভাবে জিম্মি করতে পারলেন তারা? তাহলে কি তাদের এই ‘আওয়ামী লীগ’ পরিচয় কি শুধুই নিজেদের আখের গোছানোর জন্য? দেশের প্রতি মায়া না থাকুক, নিজের দল, সরকারের প্রতি তো সামান্য দায়িত্বশীলতা থাকতে পারে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরাও নিজেদের আচরণ নিয়ে সাবধান হয়ে গেছেন ইদানিং। ব্যক্তিগত অপকর্মের জন্য দল কিংবা সরকারের বদনাম হোক, এমনটা অনেকেই চান না। সরকার এর সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা আছে। এই প্রথম আওয়ামী লীগ টানা দুই মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। প্রবৃদ্ধি নিয়মিতভাবেই সাতের ওপরে। মানুষ উন্নয়নের রাজনীতি মেনে নিয়েছে বলেই মনে হয়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে ঢাকার এক শ্রেণির ‘সুশীল’ মানুষের এত কথা, কিন্তু পাবলিকের সেদিকে খেয়াল নাই। সবাই উন্নয়নের রাজনীতি মেনে নিয়ে কাজে ডুবে ছিল। এর মধ্যে কীভাবে এই দুই মন্ত্রীর উপস্থিতিতে শ্রমিক নেতারা দেশ অচলের সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন? শাজাহান খানের রাজনৈতিক অতীতও সামনে চলে এসেছে শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে সরগরম সামাজিক মাধ্যমসমূহে। উনি জানামতে জাসদ করতেন, গণবাহিনীর লিডার ছিলেন। মানুষের প্রতি, দেশের প্রতি, সরকারের প্রতি, শেখ হাসিনার প্রতি সামান্যতম ভালোবাসা থাকলে এই শ্রমিক নেতারা, মন্ত্রীরা তাদের শ্রমিকদের ‘বাঁচানোর’ নামে পুরো দেশকে জিম্মি করতে পারতেন না। সামনে নির্বাচন। ২০১৯ সাল বেশি দূরে না। মানুষকে এভাবে কষ্ট দিয়ে ক্ষমতায় থাকা কঠিন হবে আওয়ামী লীগের। তাই জনবিরোধী, দলবিরোধী কাউকে দলে এবং সরকারে না রাখাই মঙ্গলজনক হবে বলে ধারণা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031