দুই কাউন্সিলরসহ অন্তত ১২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে রাজধানীর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু হত্যাকাণ্ডে। কিলার আব্বাসের এক সময়ের সহযোগী সালেহ ও মুসাকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাসাবো এলাকার পেশাদার খুনি ‘ম’ আদ্যক্ষরের একজন কিলারসহ টিপু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া দুইজন গোয়েন্দা জালে রয়েছে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিপু হত্যাকাণ্ডের খুনি শনাক্ত এবং মোটিভও এখন স্পষ্ট। নেপথ্যের কুশীলবদের সম্পর্কে নিশ্চিত হতে স্থানীয় রাজনীতিবিদ, কাউন্সিলর ও ভাড়াটে খুনিদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার কাউন্সিলর মাহবুবুল আলম, মতিঝিলের কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুর ও তার এক সহযোগীকে শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত ১১টার দিকে তাদের ডিবি কার্যালয় থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে কথা বলতে কাউন্সিলর মাহবুবুল আলমের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরের একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম বলেন, টিপু হত্যার রহস্য শিগগির উদ্ঘাটন করা হবে। টিপু হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেকগুলো বিষয় সামনে রেখে কাজ করছে ডিবি। শিগগিরই একটা ভালো খবর জানাতে পারবেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এদিকে, মতিঝিল, শাহজাহানপুর ও খিলগাঁও এলাকায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা আরও রক্তপাতের আশঙ্কা করছে। শাহজাহানপুর এলাকার আওয়ামী লীগের এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, ‘তিনি ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। কার দায় আবার কার ওপর চাপে। কে আবার টার্গেট করে। সেই ভয় সবার মধ্যে কাজ করছে।’ যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, টিপু হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক কিনা, এখনো মন্তব্য করার সময় আসেনি।
এদিকে টিপু হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন আগে তাকে একটি ফোন থেকে বলা হয়েছিল- ‘চাচা আপনি খুন হতে পারেন’। সেই ফোন নম্বরটি শনাক্ত করলেও ফোন করা ব্যক্তিকে ধরতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
স্থানীয়রা বলছেন, মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোচা বাবুকে যারা হত্যা করেছিল, টিপু হত্যাকাণ্ডেও তারা জড়িত। বোচা বাবুর বাবাকে শেল্টার দিতেন টিপু। মামলার সমস্ত খরচসহ বিভিন্ন সময় টাকা পয়সাও দিতেন। টিপুর কারণেই বোচা বাবুর হত্যাকারীরা ফেঁসে গেছে বলে খুনিদের ধারণা। এ ব্যাপারে একজন প্রভাবশালী নেতার মাধ্যমে মধ্যস্থতা করতে গেলেও টিপুর কারণে খুনিরা সেটা করতে পারেনি।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বোচা বাবু হত্যাকাণ্ডে ভাড়াটে খুনি সালেহ ও মুসার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডে ফেঁসে যাওয়ার ক্ষোভ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে টিপুকে খুন করা হয়। টিপুকে খুন করতে তার প্রতিপক্ষ একাধিক গ্রুপ একজোট হয়ে কিলিং মিশন সম্পন্ন করে।
মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের বশিরুল আলম খান আমাদের সময়কে বলেন, টিপু হত্যাকাণ্ডটি রাজনৈতিক নয়। এটা কাঁচা টাকার নেশায় একে অন্যের রক্ত ঝরিয়েছে। টিপুর টেন্ডারবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় টিপু তার সঙ্গেই রাজনীতি করতেন। তখন তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ছিল না। তবে সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। সেই দ্বন্দ্ব থেকেই টিপু খুন হতে পারেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলছিল। থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরও টিপুকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া হতো না। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টিপুর সঙ্গে থানা আওয়ামী লীগের রেশারেশি ছিল।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থের কারণে টিপুর প্রতিপক্ষ ডজনখানেক ব্যক্তিকে সন্দেহভাজনের তালিকায় রেখে পুলিশ তদন্ত করছে। সালেহ ও মুসার পাশাপাশি মতিঝিল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার সোহেল ও তার ক্যাডার রিফাতের নামও সন্দেহভাজনদের তালিকায় রাখা হয়েছে। তাদেরকেও পুলিশ খুঁজছে।
জানা গেছে, শাহজাহানপুর, মতিঝিল ও খিলগাঁও এলাকার পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ ওরফে ফ্রিডম মানিকের সঙ্গে শাহরিয়ারের সুসম্পর্কের তথ্য পাওয়ায় পুলিশ তাদেরকেও নজরদারিতে রেখেছে। টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি যে ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, একই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার স্ত্রী। এটি নিয়েও তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের তথ্য পেয়েছে পুলিশ। ইতোমধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য স্থানীয় কাউন্সিলরসহ একাধিক সরকার দলীয় নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। কার নির্দেশে, কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সে বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে ডিবির একাধিক কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগ নেতা টিপু ও কলেজছাত্রী প্রীতি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ইতোমধ্যে সন্দেহভাজন একাধিক ব্যক্তিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। ডিবি কর্মকর্তারা আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার জাহিদুল ইসলাম টিপুর অনেক প্রতিপক্ষ রয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়াও ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণেও এই হত্যাকাণ্ড হতে পারে।
মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আবদুল আহাদ বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা টিপু ও কলেজছাত্রী প্রীতি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত, গ্রেপ্তার ও কারণ উদঘাটনের জন্য মাঠে একাধিক টিম কাজ করছে। আশা করা যায়, খুব শিগগিরই এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটিত হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এই মামলার তদন্তভার শাহজাহানপুর থানা পুলিশের কাছেই রয়েছে।
ঘটনাস্থল থেকে সিআইডির ক্রাইম সিন আলামত সংগ্রহের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। সংগৃহীত আলামত পর্যালোচনা করে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, এই খুনে ঘাতক নাইনএমএম পিস্তল ব্যবহার করেছিল। সেভেন পয়েন্ট সিক্সফাইভ ক্যালিবারের পিস্তলে অটোমেটিক একনাগাড়ে ১৫টি গুলি করা যায়।
গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে শাহজাহানপুরের আমতলা এলাকায় অজ্ঞাতপরিচয় অস্ত্রধারীর গুলিতে নিহত হন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু এবং ২৪ বছর বয়সী কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতি।
