বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তাঁদের চেম্বারে গিয়ে রোগীকে দেখাতে হলে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ফি নেন। সাধারণ এমবিবিএস যাঁরা জেনারেল প্র্যাকটিশনার, তাঁদের ফিও ৩০০ টাকার কম নয়। বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা পাওয়া ক্রমেই দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত, এমন কি নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজনের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। তাছাড়া ব্যবস্থাপত্র ছাড়াও তাঁরা নানা পরীক্ষা করতে ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন তাতে কোন টেস্টে বা পরীক্ষায় ৬০০/৭০০ টাকা দিতে হয় ল্যাবরেটরিতে। এই টাকার সংস্থান করা দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে তাঁরা চিকিৎসা সেবা নিতে পারেন না। দেশের প্রতি নাগরিকের জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সরকারেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা এই পাঁচটি দেশের প্রতি মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এসব মৌলিক অধিকার এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়নি। আর বেসরকারি চিকিৎসা সেবা খাত তো বাণিজ্য হয়ে উঠেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সম্প্রতি একথাটি বলেছে। টিআই বি বলছে, দেশের বেসরকারি চিকিৎসাসেবা খাতে বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা প্রকট। বেসরকারি চিকিৎসাসেবায় সরকারের যথাযথ মনোযোগের ঘাটতি রয়েছে। এতে একদিকে এটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে কিছু ব্যক্তিরও খাত থেকে বিধিবহির্ভূত সুযোগ–সুবিধা আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আইনের সীমাবদ্ধতা। অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হলেও রোগীর নিকট আত্মীয় স্বজনের অভিযোগ করার কোন আইন নেই। আবার বিভিন্ন বিষয়ে চিকিৎসক, কর্মকর্তা–কর্মচারী এবং সেবা গ্রহীতার আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বাগবিতন্ডা, সংঘাত ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও সেবা প্রদানকারীর নিরাপত্তা এবং প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষায় নির্দিষ্ট কোন আইন নেই। বেসরকারী চিকিৎসা খাতে তদারকি ব্যবস্থাও দুর্বল। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে উদাসীন। কোন ধরনের জবাবদিহির সম্মুখীন না হয়ে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীর প্রায় সাড়ে ৬৩ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেই সেবা নেয়। কিন্তু বাংলাদেশে ‘বেসরকারি’ চিকিৎসাসেবা উচ্চমুনাফাভিত্তিক খাত। মালিকরা বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়েছে। তাদরকির অভাব থাকায় সেবাগ্রহীতাদের জিম্মি করে উচ্চ মুনাফা আদায় করে যাচ্ছে।
রোগাক্রান্ত মানুষ সুস্থ হওয়ার আশায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। আর চিকিৎসকের অবহেলা অমনোযোগের কারণে যদি রোগীর মৃত্যু হয় তখন তা মেনে নেয়া বাস্তবিকই কষ্টকর। একথা সকলেই জানেন, সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দেশে লাগামহীনভাবে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনষ্টিক সেন্টার ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। এগুলো পরিচালনায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা খুব একটা করা হয়। ন্যূনতম জনবল তথা চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ছাড়া স্বাস্থ্যসেবার নামে বাণিজ্য চলছে অবাধে। চিকিৎসায় অবহেলার বিষয়টি প্রমাণসাপেক্ষে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি প্রদান যুুক্তিসঙ্গত হলেও এ সংক্রান্ত আইন কার্যকর না করে তা নিয়ে বছরের পর বছর রশি টানাটানি চলছে।
আইনি সীমাবদ্ধতা, বিদ্যমান যে আইন রয়েছে তা বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে হালনাগাদ না করা, আইন ও নীতির প্রয়োজনীয় প্রয়োগ না করা এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ, পরিদর্শন ও তদারক কার্যক্রমে দুর্বলতাসহ সরকারের যথাযথ মনোযোগের ঘাটতির কারণে বেসরকারি চিকিৎসাসেবা খাত নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। ফলে অতিমুনাফাভিত্তিক বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেবার অতিরিক্ত মূল্য আদায়সহ কিছু ব্যক্তির এ খাত থেকে বিধিবহির্ভূত সুযোগ–সুবিধা আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার দুর্বলতা ও অনিয়মের প্রবণতা অধিকতর লক্ষণীয়। অবকাঠামো, জনবল ও যন্ত্রপাতির ঘাটতিসহ সার্বিক সক্ষমতায় ঘাটতি থাকায় সেবাগ্রহীতারা সঠিক ও মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একই সাথে আর্থিক ও স্বাস্থ্যগতভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দেশের চিকিৎসাসেবার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন সেবাগ্রহীতারা। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসাসেবা গ্রহণের জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। যাঁরা স্বল্প আয়ের, তাঁরা দূরে আর কোথাও যাওয়ার সঙ্গতি না থাকলে অন্তত পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় হলেও যাচ্ছেন। যাঁদের সঙ্গতি আছে তারা চেন্নাই, দিল্লী, বোম্বাই, হায়দ্রাবাদ বা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। এমন প্রবণতা দেশের টেকসই উন্নয়নের সহায়ক নয়। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি চিকিৎসাসেবা আইন দ্রুত পাস করে তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে।