রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার শস্যচুক্তির স্থগিতাবস্থা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সংস্থা নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে । জাতিসংঘের বক্তব্য, অবিলম্বে এ চুক্তি আবার কার্যকর না করা হলে আগামীতে ক্ষুধার কারণে বিশ্বের বহু মানুষের মৃত্যু ঘটবে। অন্যদিকে রাশিয়া বলছে, গতবার যে চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছিল- তার শর্ত মস্কো মানলেও যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা মানেনি। তাই মস্কো দ্বিতীয়বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দিতে আগ্রহী নয়।

শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে শস্যচুক্তি না হওয়ায় ভবিষ্যতে এর ভয়াবহতা নিয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলো বিতর্কে জড়ান। বৈঠকে উপস্থিত জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিভাগের শীর্ষনির্বাহী মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, ‘বিশ্বের ৬৯টি দেশের ৩৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছেন। তারা প্রায় সম্পূর্ণভাবে খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।’

তিনি বলেন, ‘গত বছর শস্যচুক্তি হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে গমের দাম কমেছিল ২৩ শতাংশেরও বেশি। এ কারণে এই চুক্তি থাকাকালে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আওতায় আফগানিস্তান, জিবুতি, কেনিয়া, সোমালিয়া, সুদান, ইয়েমেনসহ দারিদ্র্য ও সংঘাতপীড়িত বেশ কয়েকটি দেশে খাদ্য সহায়তা হিসেবে প্রায় ৭ লাখ ২৫ হাজার টন গম আমরা পাঠাতে পেরেছি। কিন্তু এখন চুক্তি কার্যকর না থাকায় গমের দাম বিশ্বজুড়ে বাড়ছে এবং স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশের দরিদ্র পরিবারগুলো ইতোমধ্যে সেই মূল্যবৃদ্ধির আঁচ পাচ্ছে। যদি এই চুক্তি কার্যকর না করা হয়, সেক্ষেত্রে সামনের দিনগুলোয় বহু মানুষ না খেয়ে মরা যাবে।’

এরপর রাশিয়ার পক্ষে জাতিসংঘে কর্মরত রুশ প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ও অর্থনীতিবিদ মিখাইল খান গ্রিফিথসের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, ‘গত বছর চুক্তি সম্পাদনের পর থেকে এ পর্যন্ত ইউক্রেন থেকে যে পরিমাণ গমের চালান গিয়েছে, তার মাত্র ৩ শতাংশ পেয়েছে দরিদ্র দেশগুলো। বাকি সব গম নিয়েছে ধনী বিভিন্ন দেশ।’

তিনি আরও বলেন, ‘তাই বিগত শস্যচুক্তি কার্যকর করা হলে দরিদ্র দেশগুলো উপকৃত হবে, কিংবা বিশ্ববাজারে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে- এমনটা আমরা মনে করছি না।’

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালে রুশ বাহিনী ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর পর কৃষ্ণসাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গম রপ্তানিকারী দেশ ইউক্রেনের শস্যগুদামগুলোয় আটকা পড়ে লাখ লাখ টন গম, ভুট্টা, ও সূর্যমুখীর বীজ।

এতে ইউরোপ ও এশিয়ার বাজারগুলোয় গম ও ভোজ্যতেলের জোগান সংকট শুরু হয় এবং বিশ্বজুড়ে হু-হু করে বাড়তে থাকে খাদ্যশস্য আর ভোজ্যতেলের দাম। এই পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের আগস্টে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গত বছর আগস্টে চুক্তি সম্পাদনের পর থেকে এ পর্যন্ত কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে সেটির মেয়াদ। সর্বশেষ মেয়াদ বৃদ্ধির সময়সূচি অনুযায়ী, ১৭ জুলাই ছিল এই চুক্তির শেষ দিন।

তথ্য অনুযায়ী, চুক্তিতে ইউক্রেনের শর্ত ছিল, কৃষ্ণ সাগরের জাহাজ চলাচলের পথ থেকে সব মাইন অপসারণ করতে হবে এবং শস্যবাহী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে নিরাপত্তা দিতে হবে।

এদিকে রাশিয়ার শর্ত দিয়েছিল- ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার শস্য ও কৃষিপণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা যেসব আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেসব তুলে নিতে হবে।

কিন্তু চুক্তি সম্পাদনের পর দেখা যায়, রাশিয়া শর্ত মেনে শস্যবাহী জাহাজগুলোকে নিরাপত্তা দিলেও রাশিয়ার শস্য ও কৃষিপণ্যের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি পশ্চিমা বিশ্ব।

রাশিয়া যে এ ব্যাপারটিতে খুবই ক্ষুব্ধ- তা গত কয়েক মাস ধরেই জানান দিচ্ছে মস্কো। গত ১৮ জুন রুশ দৈনিক ইজভেস্তিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিনের প্রেস সেক্রেটারি ও মুখাপাত্র পেসকভ বলেছিলেন, ‘এই চুক্তির পেছনে আমাদের কিছু শর্ত ছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য- সেসবের কোনোটিই মানা হয়নি। ভবিষ্যতে কী হবে- তা এখন বলা খুবই কঠিন; তবে আমরা বলতে পারি- মস্কো আর এই চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে আগ্রহী নয়। আমরা অনেক ভদ্রতা দেখিয়েছি, অনেক ছাড় দিয়েছি কিন্তু আর নয়।’

উল্লেখ্য, চলতি মাসের ১৭ তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে শস্যচুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয় মস্কো। এ ঘটনার পর থেকেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এই চুক্তি নবায়নের সম্ভাবনা।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031