
ঢাকা : তুরস্কের ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান করা হয়েছে জেনারেল উমিত দুনদারকে। তিনি জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর মূল নেতৃত্ব এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেছে। এ ছাড়া যারা অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সামরিক বাহিনী তাদের সরিয়ে দিতে বদ্ধ পরিকর।
এরদোয়ান সরকারকে হটাতে অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আত্মসমর্পণ করেছেন সেনা সদস্যরা। অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এখন পর্যন্ত পাঁচ জেনারেলসহ প্রায় তিন হাজার সেনাকে গ্রেপ্তার করেছে তুরস্ক পুলিশ। অভ্যুত্থানের চেষ্টাকালে ১০৪ সেনা সদস্যসহ ২৬৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন সহস্রাধিক।
বিবিসির খবরে বলা হয়, তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ওমের সেলিক জানান, পরিস্থিতি এখন ৯০ শতাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে। তবে এখনো কয়েকজন সেনা অধিনায়ক অভ্যুত্থানের পক্ষের সেনাদের হাতে জিম্মি হয়ে আছেন।
এদিকে তুরস্কের পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও নিজ দলের সমর্থকদের রাস্তায় থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। যেকোনো সময় আবার এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তিনি। এএফপির খবরে জানানো হয়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম টুইটারে দেয়া এক বার্তায় এরদোয়ান বলেন, ‘সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, আমাদের সারা রাত রাস্তায় থাকতে হবে। কারণ, যেকোনো মুহূর্তে আবার নতুন করে এ ধরনের ঘটতে পারে।’
শুক্রবার গভীর রাতে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা, ইস্তাম্বুলসহ বেশ কিছু শহরের দখল নিতে শুরু করে সেনারা। তুরস্কের সংসদের বাইরে সেনা ট্যাঙ্ক মোতায়েন করে শুরু হয় গোলাগুলি। রাজধানীর বাইরে থাকা এরদোয়ান এ সময় তার দলীয় নেতাকর্মীকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাধারণ মানুষ পথে নামে। সেনার একাংশ প্রতিবাদী জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তুরস্কের জাতীয় টেলিভিশন, ইস্তাম্বুল এবং আঙ্কারার বিমানবন্দর দখল করে। সেনার পক্ষ থেকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য সামরিক অভ্যুত্থান করা হয়েছে বলে জানিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এর পরে জানা যায়, সামরিক বাহিনীর একটি অংশ এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত।
সূত্রের খবর, নিচু স্তরের সেনা সদস্যরা এই অভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছিলেন। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এটাকে অভ্যুত্থান বলে মানতে নারাজ। তার মতে এটা সেনা বিদ্রোহ। এর পরেই ইস্তাম্বুলে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান জানান, বিদ্রোহী সেনাদের বিরুদ্ধে চরম পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এরদোয়ানের ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ তুরস্কে সর্বেসর্বা। ইসলামের ভিত্তিতে এই দলটি প্রতিষ্ঠা। কিন্তু তার ক্ষমতা যত তীব্র হয়েছে ততই তুরস্কে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এরদোয়ানের হাত ধরে ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক ইসলামের দিকে ঝুঁকছে বলে অভিযোগও উঠেছিল। তা ছাড়া প্রথম থেকেই তিনি সেনাকে তুরস্কের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বিপুল জনপ্রিয়তার কারণেই সেনারা তার বিরুদ্ধে মাথা তুলতে পারেনি।
৫০ বছরে চার দফা সেনাশাসন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের মধ্যে দিয়ে তুরস্কে গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু। কিন্তু সেই পথচলা বারবার হোঁচট খেয়েছে। গত ৫০ বছরে দেশটিতে কমপক্ষে চারটি সফল সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি ব্যর্থ সেনা অভুত্থানের চেষ্টা তো রয়েছেই। এর মধ্যে তিন বার অভ্যুত্থানে সরাসরি ক্ষমতা দখল করে তুরস্কের সেনাবাহিনী, আর ১৯৯৭ সালে ‘প্রস্তাবনা’ দিয়ে ক্ষমতার রদবদল ঘটায়।
প্রথম অভ্যুত্থান ১৯৬০ সালে
ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে বিরোধীদের চরম উত্তেজনার মধ্যে ১৯৬০ সালে তুরস্কে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। ওই সময় তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধানমন্ত্রী আদনান মেনদেরস ও প্রেসিডেন্ট সেলাল বায়ার আতাতুর্ক যুগের বেশ কিছু নিয়মনীতি বদলে ধর্মীয় নিয়মনীতির প্রচলন করেন। সরকারের দমন-পীড়নমূলক আইন ও সমালোচনাধর্মী পত্রিকা বন্ধের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন শুরু করে বিরোধীরা। এ অবস্থায় ১৯৬০ সালের শুরুর দিকে জরুরি অবস্থা জারি করে ক্ষমতাসীন সরকার। এরপরই তুরস্কের ইতিহাসে প্রথমবারের মত দৃশ্যপটে আসে সেনাবাহিনী।
ওই বছরের ২৭ মে অভ্যুত্থান ঘটায় তারা। তাৎক্ষণিকভাবে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’সহ বেশ কয়েকটি অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সেমাল গুরসেল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সেনা-নিয়ন্ত্রিত নতুন রাজনীতির সূচনা করেন, অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী আদনান মেনদেরসকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। প্রথম এ অভ্যুত্থানের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৯৬৫ পর্যন্ত।
দ্বিতীয় অভ্যুত্থান ১৯৭১ সালে
পুরো ৬০-র দশকে অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে তুরস্কে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করে। ওই সময় শ্রমিক সংগঠনগুলো বেশ কয়েকটি বড় বড় প্রতিবাদ কর্মসূচি সংঘটিত করে।পাশাপাশি ডানপন্থি দলগুলোও নানা ধরনের সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল। কমছিল মুদ্রার মান, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছিল বছর বছর ৮০ শতাংশ হারে। এ অবস্থায় এক দশকের মধ্যেই দ্বিতীয় অভ্যুত্থান হয় তুরস্কে।
‘শৃঙ্খলা ফেরাতে’ ১৯৭১ এর মার্চে দেশটির চিফ অব জেনারেল স্টাফ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সুলিমান ডেমিরেলকে দেশ পরিচালনায় কামাল আতাতুর্কের দর্শন মেনে নতুন একটি শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য সরকার গড়তে ‘স্মারকলিপি’ দেন। কয়েক ঘণ্টা পর মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন ডেমিরেল।
রক্তপাতহীন ওই অভ্যুত্থানে পর ‘সরাসরি’ ক্ষমতায় বসেনি সামরিক বাহিনী। তারা প্রথমে ডানপন্থি রিপাবলিকান পিপলস পার্টির নেতা নিহাত এরিমকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান নিযুক্ত করে। দুই বছর পর দেশটির সংসদ অবসরপ্রাপ্ত নৌ কর্মকর্তা ফাহরি কোরুতার্ক-কে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়।
তৃতীয় অভ্যুত্থান ১৯৮০ সালে
দ্বিতীয় দফা অভ্যুত্থানের পরের আট বছরে ১১জন প্রধানমন্ত্রী বদল করে তুরস্কের পার্লামেন্ট। অর্থনীতির ক্রমঅধোগতি আর বাম-ডান দলগুলোর মুখোমুখি সংঘর্ষে তুরস্কের রাস্তাগুলো তখন পরিণত হয়েছিল রক্তের সমুদ্রে। ১৯৭৯ সালের শেষ দিক থেকে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের গুঞ্জন ওঠে। পরের বছর মার্চে কয়েকজন জেনারেল অভ্যুত্থানের প্রক্রিয়া শুরু করে। বেশ কয়েকবার বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর সেপ্টেম্বরে তাদের চেষ্টা সফল হয়।
১৯৮২ সালে নতুন সংবিধান প্রণয়নে গণভোটের ডাক দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাতে সাড়া দেয়, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যায়।
চতুর্থ অভ্যুত্থান হয় ১৯৯৭ সালে
তুরস্কের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ‘হস্তক্ষেপের’ সর্বশেষ ঘটনা ঘটে ১৯৯৭ সালে।
ইসলামপন্থি ওয়েলফেয়ার পার্টি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার রাষ্ট্রে ‘মৌলবাদী নীতি’ প্রয়োগের চেষ্টা করছে এমন অভিযোগ এনে সেনাবাহিনী সরকারকে কয়েকটি প্রস্তাব দেয়। ইসলামপন্থি সরকার সেগুলো মেনে নিতে বাধ্য হয়। পরে সেনাবাহিনীর চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেকমেতিন এরবাকান। পরের বছর তুরস্কে ওয়েলফেয়ার পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়, এরবাকানকে দেয়া হয় পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা।
সরাসরি অভ্যুত্থান না করেও সরকার বদলের এ ঘটনাকে বিশ্লেষকরা ‘উত্তরাধুনিক ক্যু’ হিসেবে অভিহিত করেন।
নিষিদ্ধঘোষিত ওই ওয়েলফেয়ার পার্টির অনেক সদস্য পরে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এ কে) পার্টিতে যোগ দেন, যাদের মধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানও একজন।
