বছরের প্রথম ঝড়, শিলাবৃষ্টি আর বজ্রপাতে প্রাণ গেছে দুই দিনমজুরের রংপুরে । রংপুর বিভাগজুড়ে দফায় দফায় এই ঝড়ে আহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। লিচু, আমের মুকুলসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষক এবং কৃষি বিভাগ।

শুক্রবার সকালে হঠাৎ শিলাবৃষ্টি সেই সঙ্গে বজ্রপাত শুরু হয়। এতে রংপুরের বদরগঞ্জের শামিম মিয়া (৩৫) ও তারাগঞ্জ উপজেলার নয়া মিয়া (৪০) নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয়েছে বেশ কয়জন।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, দুপুর ১২টার দিকে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। রংপুর নগরীর কিছু এলাকা ছাড়াও গঙ্গাচড়া, পীরগঞ্জ, মিঠাপুকুর, তারাগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এই ঝড় আঘাত হানে। ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৬৫ কিলোমিটার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ঝড়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পীরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়।

পীরগঞ্জ উপজেলার কাবিলপুর ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম জানান, হঠাৎ ঝড়োবৃষ্টিতে তার ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বাড়ি ঘর উপড়ে গেছে, নষ্ট হয়েছে গাছপালা। জমির ফসলও নষ্ট হয়েছে। তার দাবি কাবিলপুর ইউনিয়নের ৩০ জনের বেশি আহত হয়েছে।

একই উপজেলার টুকুরিয়ার চেয়ারম্যান আতোয়ার রহমান বলেন, বৃষ্টির চেয়ে ক্ষতি করেছে ঝড় আর শিলাবৃষ্টি। এতে ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে কাঁচা বাড়িঘরও ভেঙে গেছে। সেগুলো মেরামত করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন।

পীরগঞ্জের চতরা ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক শামীম জানান, ঝড়ের চেয়ে শিলাবৃষ্টিতে তাদের এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে আটজনকে পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিঠাপুকুরের ১২নং মিলনপুর ইউনিয়নের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় কৃষক রবিউল ইসলাম জানান, পাথরের মতো শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধানক্ষেত, ভুট্টাসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে কাচথোর হয়েছে যে ধান সেই ধানের ক্ষতি হয়েছে বেশি।

লালমনিরহাটে ১০ মিনিটের তাণ্ডব

লালমনিরহাটে ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে বসত-বাড়িসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ১০ মিনিট স্থায়ী এ শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে জেলার হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার বসত-বাড়িসহ জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। কী পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে তা এখনো নির্ধারণ করা যায়নি।

হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শিলাবৃষ্টি কারণে ওই দুই উপজেলার হাজার হাজার বসত-বাড়ির ঘরের উপরের টিন ফুটা হয়ে গেছে। এছাড়া ভুট্টা ও ইরি-বোরোসহ বিভিন্ন ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।

হাতীবান্ধা উপজেলার দ. গড্ডিমারী গ্রামের আজিজার রহমান জানান, তার চারটি টিনের ঘরে একটি টিনও ভালো নেই। এছাড়া ১২ বিঘা জমির ভুট্টা ও ১৫ বিঘা জমির ইরি-বোরো ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

হাতীবান্ধা উপজেলার সিঙ্গিমারী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন দুলু জানান, শিলাবৃষ্টির কারণে তার ইউনিয়নের শত শত বসত বাড়িসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।

হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, ভয়াবহ এ শিলাবৃষ্টিতে বসত বাড়িসহ বিভিন্ন ফসলি ক্ষেতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে সহযোগিতার জন্য দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হবে।

‘এমন ঝড়’ দেখেনি কুড়িগ্রামবাসী

একই অবস্থা কুড়িগ্রামেও। বিশেষ করে এই জেলার নাগেশ্¦রী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় ক্ষতি বেশি হয়েছে।

নাগেশ্বরী উপজেলার বালাটারি গ্রামের কৃষক আব্দুল কাদের বলেন, দেশ স্বাধীনের পর এত জোরে ঝড় ও বৃষ্টি হলো। আগে কখনো এমন ঝড় দেখেননি তিনি। বলেন, এই ঝড়ে তার দুটি ঘর উড়ে গেছে, সুপারির গাছ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের গাছ উপড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে শাক এবং ধানের।

একই গ্রামের বক্তার আলী বলেন, ঝড়ের কারণে রাস্তার গাছ উপড়ে পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাগেশ্বরী উপজেলার বালাটারী, সুখাতি, পায়রাডাঙ্গা, বাগডাঙ্গা, নেওয়াশী, ভুরুঙ্গারী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

দিনাজপুরে ব্যাপক ক্ষতি

দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায় দুপুর পৌনে ১২টায় হঠাৎ শিলাবৃষ্টিসহ ঝড়ো-হাওয়া বয়ে যাওয়ায় জনজীবন থমকে যায়। এতে গাছে গাছে সদ্য আসা আম ও লিচুর গুটিসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।

স্থানীয় লোকজন জানান, চৈত্র মাসের হঠাৎ এ বৃষ্টিতে বিপাকে পড়েন পথচারীরা। বৃষ্টির পাশাপাশি বয়ে যায় দমকা হাওয়া। প্রায় আধা-ঘণ্টা ধরে হওয়া বৃষ্টিতে কোথাও কোথাও শিলার স্তুপ জমে যায়।

নীলফামারীতে ফসল ও বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি

শিলাবৃষ্টিতে নীলফামারীর জলঢাকা, ডোমার ও ডিমলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শিলার আঘাতে টিনের চাল ফুটো হয়ে গেছে। এছাড়া ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হওয়া শিলাবৃষ্টির আঘাতে জেলার ডোমার ও ডিমলার ১২ ইউনিয়নের প্রায় ৩৫০ বসত ঘরের টিনের চাল ফুটো হয়ে গেছে। আর ডিমলায় শিলাবৃষ্টিতে তিনজনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

ডোমারের ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নগুলো হলো, কেতকিবাড়ী, গোমনাতী, ভোগডাবুড়ি, বামনিয়া ও পাঙ্গা মটুকপুর।

জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ভারী শিলাবৃষ্টির কারণে ডোমার ও ডিমলা উপজেলায় ভুট্টা, মরিচ, পেঁয়াজ, বোরোর ক্ষেতসহ বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়েও ঝড়ের ক্ষতি

পঞ্চগড় জেলার প্রতিটি উপজেলায় কমবেশি ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি শিলাবৃষ্টি হয়েছে সদর উপজেলায়। এ উপজেলার হাড়িভাসা, হাফিজাবাদ, কামাত কাজলদিঘী ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকার টমেটো ও তরমুজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝরে গেছে আম ও লিচু বাগানের গাছের মুকুল। এছাড়া গম ও ভুট্টা ক্ষেতেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

ঠাকুরগাঁওয়ে শিলা বৃষ্টি আর  ঝড়ে পাকা গম ও আমের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে মাটির খড়ের তৈরি কাঁচা বাড়িঘরেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি।

সড়কে গাছপালা ভেঙে পড়ে ও বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ায় জনজীবন ও যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছে।

রংপুর আঞ্চলিক কৃষি কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, কী পরিমাণ ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে তা তাৎক্ষণিক নিরূপণ করা যায়নি। আমাদের কর্মকর্তা কাজ করছেন, আমরা দ্রুত ক্ষতির পরিমাণটা জানাতে পারবো।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কাজী হাসান আহমেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ক্ষতির পরিমাণ জানতে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031