প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন রাজধানীর প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি করে খেলার মাঠ কিংবা পার্ক তৈরির কথা  । তার সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করেই রাজধানীর তেঁতুলতলা মাঠে কলাবাগান থানা ভবন নির্মাণের জন্য অনাপত্তির আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) দিয়েছেন সাবেক স্থানীয় এমপি। পুলিশ বলছে, সেই ডিও লেটার তেঁতুলতলা মাঠে থানা ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে গতি এনেছে। খেলার মাঠে থানা নির্মাণে পুলিশের এ উদ্যোগ দাগ কেটেছে নগরবাসীর মনে। মাঠ বাঁচাতে প্রতিদিনই তারা আন্দোলন-ক্ষোভ-প্রতিবাদ-মানববন্ধন করছে। মাঠের দাবিতে শিশুরাও আকুতি জানাচ্ছে। মাঠে থানা ভবন না করতে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন নগরবিদ, পরিবেশবিদ, মানবাধিকারকর্মীসহ বিশিষ্টজনরা।

নাগরিকরা প্রবল প্রতিবাদে সোচ্চার হলে গত সোমবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানন, আপাতত মাঠটিতে থানা ভবন হচ্ছে না। এটি মাঠ হিসেবে থাকবে, না সেখানে থানার জন্য ভবন করা হবে তা আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হবে। থানার জন্য বিকল্প জমি খোঁজার কথাও জানান তিনি।

কিন্তু বাস্তবে কোনো কিছুকেই ধর্তব্য মনে করছে না পুলিশ। খেলার মাঠে থানাভবন নির্মাণে অনড় তারা। গতকাল মঙ্গলবারও আগের মতো পুলিশি পাহারায় থানা ভবনের প্রাচীর নির্মাণের কাজ চলে। যদিও মুক্ত বাতাসের এক টুকরো মাঠের আশায় হাল ছাড়ছেন না এলাকাবাসী। বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে পুলিশের সামনেই গতকালও মাঠ রক্ষায় প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেছেন তারা।

এই পরিস্থিতি গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে তাদের অবস্থান জানানো হয়। তেঁতুলতলা মাঠ না ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়ে ওই এলাকার শিশুদের খেলাধুলার জন্য কলাবাগান ক্লাবের মাঠটি দেখিয়ে দেয় পুলিশ। মাঠের বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানানোর পরদিন গতকাল সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে নিজেদের অবস্থান জানায় ডিএমপি।

ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে কলাবাগান লেকসার্কাস এলাকার তেঁতুলতলা মাঠটি কীভাবে পুলিশের হলো, সেই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। মাঠটি কী উপায়ে কলাবাগান থানা ভবন নির্মাণের জন্য বরাদ্দ পাওয়া গেছে, কীভাবে সরকারি অন্যান্য সংস্থার ছাড়পত্র পাওয়া গেছে, তা সবিস্তারে তুলে ধরা হয় বিজ্ঞপ্তিতে। এতে দাবি করা হয়, এলাকাবাসীর নিরাপত্তার সুবিধার্থে তেঁতুলতলা মাঠে স্থায়ীভাবে কলাবাগান থানা ভবন নির্মাণের জন্য স্থানীয় সাবেক সাংসদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দিয়েছিলেন। বিজ্ঞপ্তিতে সেই সাংসদের নাম না থাকলেও জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র ওই এলাকার এমপি থাকাকালে ওই ডিও লেটার দেন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিকল্প খেলার মাঠের ব্যবস্থার বিষয়টি ঢাকা মহানগর পুলিশের এখতিয়ারভুক্ত নয়। তেঁতুলতলা মাঠ থেকে কিছু দূরে কলাবাগান মাঠ রয়েছে। সেখানে বাচ্চাদের খেলাধুলাসহ সামাজিক অনুষ্ঠান করার সুযোগ রয়েছে। সরকার বললে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবেও বলে জানায় ডিএমপি।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ওই জমি অধিগ্রহণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন নেওয়া হয়, রাজউকের ছাড়পত্র পাওয়া যায়, জায়গাটির প্রস্তাবিত ভূমি ব্যবহার আরবান রেসিডেন্সিয়াল জোন হিসেবে চিহ্নিত আছে মর্মে নগর উন্নয়নের ছাড়পত্র পাওয়া যায়, পরিবেশ অধিদপ্তরেরও অনাপত্তিপত্র পাওয়া যায়। ঢাকা জেলা প্রশাসক সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে ওই জমি অধিগ্রহণের জন্য সুপারিশসহ ভূমি মন্ত্রণালয়ের মতামত পাঠায়, সরকারের কেন্দ্রীয় ভূমি বরাদ্দ কমিটিতে ওই জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঢাকা জেলা প্রশাসক জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ ডিএমপি পুলিশ কমিশনার বরাবর ২৭ কোটি ৫৪ লাখ ৪১ হাজার ৭১০ টাকার প্রাক্কলন পাঠালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ওই টাকার ব্যয় মঞ্জুরি পাওয়া যায় এবং জেলা প্রশাসক বরাবর প্রাক্কলিত টাকা চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ডিএমপিকে জমির দখল হস্তান্তর করেন।

এদিকে গতকাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে প্রতিবাদের পরও থেমে নেই তেঁতুলতলা মাঠে থানা ভবনের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ কাজ। মাঠ রক্ষার দাবি উপেক্ষা করে পুলিশ প্রহরায় দিব্যি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন নির্মাণকর্মীরা। গতকাল সকাল ৮টায় কাজ শুরু হয়। বিম করার কাজ শেষ করে বিকালে পিলার ঢালাইয়ের কাজ শুরু হয়।

নির্মাণকাজ চলাকালে মাঠের ভেতরে কয়েকটি শিশুকে বসে থাকতে দেখা যায়। নির্মাণশ্রমিকদের উদ্দেশে তাদের বলতে শোনা যায়, আঙ্কেল, কাজ বন্ধ করেন। আমাদের মাঠ আপনারা কেড়ে নেবেন না। তাদের বক্তব্যে শ্রমিকরা জানায়, আমাদের কিছু করার নেই বাবা।

গতকাল সকাল থেকে কলাবাগান থানার ১৫ জন পুলিশ সদস্যকে তেঁতুলতলা মাঠে অবস্থান এবং মাঠ কম্পাউন্ডে দেয়াল নির্মাণকাজ তদারকি করতে দেখা গেছে। মাঠে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা জানান, ওপরের নির্দেশ অনুযায়ী তারা এখানে অবস্থান করছেন এবং তদারকি করছেন। এর বেশি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা।

মাঠ রক্ষার আন্দোলনে থাকা সৈয়দা রত্না বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। আমি আশাবাদী, মাঠটি রক্ষা পাবে। এই মাঠ রক্ষা পেলে আমার আন্দোলন সফল হবে। মাঠটি খোলামেলা থাকুক, এখানে যেন কোনো স্থাপনা নির্মাণ না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আর কিছু চাওয়ার নেই। শিক্ষার্থী কিংবা ছোট বাচ্চারা মাঠে খেলাধুলা করতে পারবে এটাই আমি চাই।

পুলিশের আটকে বিষয়ে সেদিনকার ঘটনা এবং থানা হেফাজতে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, মাঠ বাঁচাতেই আমি আন্দোলনে নেমেছি। সেদিন আমি যাওয়ার সময় এখানে ইট-বালি-সুরকি দিয়ে কাজ করা দেখে লাইভ করি। পরে আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। থানায় আমাকে যে কক্ষে রাখা হয়েছিল, সেটি ছিল অত্যন্ত নোংরা। আর কীভাবে কী হয়েছে, কীভাবে আমি আবার বের হয়ে এসেছি- বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031