পুলিশ বন্ধু মানুষের সবচেয়ে কাছের । সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পুলিশের ভূমিকা অনবদ্য। কিছু পুলিশের খারাপ কর্মকাণ্ডের জন্য এই নামটি সাধারণ মানুষের কাছে অনেক সময় বন্ধুর পরিবর্তে আতঙ্কের হলেও সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশই সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে। খারাপ কাজ করে কিছু পুলিশ সদস্য যেমন নিন্দনীয় হন, আবার ভালো কাজ করেও অনেকে পুলিশ সদস্য সংবাদের শিরোনাম হন। তেমনি ভালো কাজ করে গণমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছেন একজন নারী পুলিশ সদস্য, যিনি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত এক গাড়ি চালককে নিজ হাতে সেবা দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

ঘটনাটি গত রবিবারের। মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে আজিমপুর-গাজীপুর রুটে চলাচলকারী ভিআইপি পরিবহনের একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনে থাকা কয়েকটি গাড়িকে প্রচণ্ডবেগে ধাক্কা দেয়। এতে বেশ কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আহত হয় বেশ কয়েকজন।

দুর্ঘটনার সময় আহতদের কাতরানোর দৃশ্য অনেকে দাঁড়িয়ে দঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করলেও কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেননি। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান ডিএমপির তেজগাঁও থানায় কর্মরত পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শবনম আক্তার পপি। আহতদের এমন অবস্থা দেখে ব্যথিত হয়ে উঠে তার নারী মন। নিজেই ড্রাইভ করে বাসটিকে সরিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করেন। আহতদের নিজ হাতে দেন প্রাথমিক সেবা।

পুলিশ কর্মকর্তা পপির এই কর্মকাণ্ড মোবাইলে ধারণ করেন সেখানে উপস্থিত থাকা কয়েকজন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবিগুলো ছড়িয়ে পড়ার পর পপির এমন কাজ ভাইরাল হয়ে পড়ে। এমন কাজে তাকে স্বাগত জানায় সাধারণ মানুষ। এছাড়া পুলিশের অনেক বড় কর্মকর্তাও তাকে নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের প্রশংসামূলক মন্তব্য করেন।

গুলশান বিভাগের ডিসি মোস্তাক আহমেদও গর্ব করে লিখেছেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আহত একজন পথচারীর পা‌য়ের শুশ্রুষা কর‌ছেন একজন পু‌লিশ সদস্য। এ‌ই ছ‌বি শুধু পু‌লি‌শের সেবার কথা ব‌লে না, প‌রিবর্ত‌নের কথাও ব‌লে। শ্রদ্ধা।’

পপির মানবিক কাজের ছবি ফেসবুকে জুড়ে দিয়ে কবির চৌধুরী তন্ময় নামে একজন লিখেছেন, এটি একটি পুলিশ অফিসার কর্তৃক সাধারণ মানুষের সেবা প্রদানের ছবি। এক নারী পুলিশ অফিসার তার নিজহাত দিয়ে পায়ে ব্যান্ডেজ পড়িয়ে দিচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মানুষকে।

জানতে চাইলে শবনম আক্তার পপি ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘মহাখালীর শাহীনবাগ সিভিল এভিয়েশনের সামনে ভিআইপি পরিবহনের একটি বাস ব্রেক ফেল করে বেশ কয়েকটি প্রাইভেটকার ও মাইক্রোকে ধাক্কা দেয়। ঘটনার পর দুর্ঘটনা কবলিত বাসটির চালক হেলপাররা পালিয়ে যায়। বাসের ধাক্কায় বেশ কয়েকটি গাড়ি অচল হয়ে পড়লে ফ্লাইওভার থেকে বনানী সড়কের যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রথমে যানজট নিরসনে আমি বাসটি চালিয়ে রাস্তার পাশে নিয়ে সেটা পার্কিং করি। পরে দেখি বাসের ধাক্কায় একটি পিকআপ উল্টে একটি ছেলে আহত হয়ে রাস্তায় শুয়ে আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে তুলে হাঁটানোর চেষ্টা করি এবং একজনকে কিছু টাকা দিয়ে পাশের একটি স্কুলের সামনে থেকে আইসক্রিম কিনিয়ে এনে তার হাতে পায়ে ধরি। পরে যখন সে দাঁড়ানোর মত হরো তখন তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে তার পরিবারকে খবর দিই। এরপর গতকাল স্বজনদের কাছে কল করে জানতে পেরেছি সে সুস্থ আছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম ছেলেটি যেন স্বাভাবিক হাঁটা চলা ফেরা করে স্বাভাবিক জীবন কাঁটাতে পারে। আর তখন তাকে উদ্ধার না করা হলে হয়ত ওর অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত। এছাড়া সবারই তো পরিবার আছে। পুলিশের চাকরিতে যোগদানের সময়ই আমাদের শেখানো হয়েছে মানবতার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। তাই আমি প্রতিনিয়ত মানুষের সেবাই নিজেকে বিলিয়ে দেই।’

পাবনায় বেড়ে উঠা পপির মানুষের সেবা করার টান ছিল ছোটবেলা থেকেই। মানুষের কোনো কষ্ট দেখলে সইতে পারেন না। বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। সেদিনের মতো গত বুধবারও আরেকটি ভালো কাজের দৃষ্টান্ত রাখেন পুলিশের এই নারী কর্মকর্তা।

শবনম আক্তার পপি জানান, ‘গত বুধবার ডিউটি শেষ করে বাসায় ফেরার পথে দেখি একজন তার প্রাইভেট নিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে। পরে জানতে পারি তার গাড়ির তেল শেষ হয়ে গেছে। পরে আমি আমার ইস্কুটি থেকে তেল বের তাকে দেই।’

পপি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই মানুষের উপকারের প্রতি টান ছিল। মনে পড়ে অনেক সময় নিজের বাড়ির খাবার চুরি করে অন্যকে খাওয়াতাম। এমনকি নিজের পুকুরের মাছ চুরি করে অন্যের বাড়িতে দিয়ে আসতাম। ছোটবেলা থেকেই মনে মনে ভাবতাম আমার একটা হাত নির্ভরযোগ্য, যে হাতটাকে মানুষ বিশ্বাস করবে। যেটা দিয়ে মানুষকে উপকার করতে পারব। ছোট থেকে বাবা-মায়ের কাছ থেকে মানুষের উপকার করতে শিখেছি। তারা সবসময় আমার ভালো কাজকে অনুপ্রাণিত করত। ২০০১ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগদানের পর বিভিন্ন থানায় দায়িত্ব পালন করেছি। কোনদিন মানুষের উপকার ছাড়া ক্ষতি করিনি।’

পপির এমন কাজের প্রশংসা করে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর পপি যেভাবে নিরলসভাবে কাজ করেছেন তা প্রশংসার দাবিদার। তার এই কাজে পুলিশ বিভাগের প্রতি মানুষের বিরুপ মনোভাব কমে যাবে।’

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031