বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেট সড়কে শৃঙ্খলা না ফেরার কারণ হিসেবে পুলিশকে প্রধানত দায়ী করছেন নগরীতে সড়ক নিরাপত্তা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক সেমিনারে । তারা বলছেন, যাদের হাতে সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদের বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। তারা যদি সেটা না করে, তারা যদি ধান্ধায় লিপ্ত থাকে, বাণিজ্যে লিপ্ত থাকে তাহলে সড়কে কখনো নিরাপত্তা আসবে না।
অন্যদিকে একই অনুষ্ঠানে বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেটের এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুধু পুলিশ নয়, অনেকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সুতরাং কাউকে দোষারোপ না করে সবাই মিলে কাজ করলেই নিরাপদ সড়ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এসব বিষয়ের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মাশহুদুল কবীর বলেছেন, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার মুরাদপুরস্থ এলজিইডি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএ আয়োজিত সড়ক নিরাপত্তা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক সেমিনারে এসব অভিযোগ উঠে আসে। ওই সেমিনারে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- ‘আইন মেনে চলবো, নিরাপদ সড়ক গড়বো।’
পুলিশের ওপর ম্যাজিস্ট্রেটদের দোষারোপ : বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস এস এম মনজুরুল হক সেমিনারে বলেছেন, প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে অভিযোগ আসছে আমাদের কাছে। গাড়ির সব কাগজ ঠিক থাকার পরেও নো-পার্কিং মামলা দিচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। জরিমানার টাকার পরিমাণ স্লিপে কম দেখানোসহ ইত্যাদি। চালকরাই এসব অভিযোগ করেছেন বলে জানিয়ে তিনি বলেন, বিশাল পরিমাণে বাণিজ্য হচ্ছে এখানে। আমি প্রমাণ দিতে পারবো। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেছেন, যাদের হাতে সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদের এ বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। তারা যদি সেটা না করে, তারা যদি ধান্ধায় লিপ্ত থাকে, বাণিজ্যে লিপ্ত থাকে তাহলে সড়কে নিরাপত্তা কখনো আসবে না।
শুধু ট্রাফিক পুলিশকে দায়ী করলে অন্যায় হবে : একই অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলেছেন, আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমরা কেউ ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে না। এখন যদি এসব অভিযোগ নিয়ে বিচার বিশ্লেষণে যাই, সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি যদি বিশ্লেষণ করি এবং এখানে শুধু ট্রাফিক পুলিশকে দায়ী করলে আমার মনে হয় অন্যায় হবে।
এএসপি আরও বলেন, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুধু পুলিশ নয়, অনেকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কাউকে দোষারোপ না করে সবাই মিলে কাজ করলেই নিরাপদ সড়ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মাসুম।
এদিকে বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেট আরও বলেছেন, আমরা সবাই বলছি সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কেউ এ বিষয়ে কাজ করছি না। সবাই যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকছি। শুধু বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, অনেক পথচারী আছেন জেব্রা ক্রসিং থাকার পরেও সেটি ব্যবহার করছেন না। সমস্ত দোষ শুধু ড্রাইভারকে দিলে হবে না। পথচারীরও দোষ আছে। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে চালক-মালিক-পথচারী-সরকার সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
সড়কে শৃঙ্খলা আনতে সবাইকে সচেতন হতে হবে- অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে শুধু গাড়ির চালক-হেলপার নয়, আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে বলে জানান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাশহুদুল কবীর।
তিনি বলেছেন, পারস্পরিক আন্তরিকতার মাধ্যমে সকলের জন্য নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এর আগে ট্রাফিক বিভাগ সঠিক হলে সড়কে ও গণপরিবহনে অবশ্যই শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আরও বলেছেন, মৃত্যু সকলের জন্য সমান। কোন গাড়ি চালক ইচ্ছে করে মানুষ বা কোন প্রাণিকে হত্যা করতে চায় না। সেও নিরাপদে গাড়ি চালাতে চায়। নিজে বাঁচতে চাইলে অন্যের মৃত্যু হবে না। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। অনেক চালক মনে করেন নিজে বাঁচবো, কাউকে মারবো না। এরপরও দুর্ঘটনা ঘটে যায়। কিভাবে সড়ক ব্যবহার করতে হবে, কিভাবে সড়কে নিরাপদ থাকতে হবে তা প্রত্যেক পরিবারের সদস্যদের অবহিত করতে হবে। শিশুরা কিভাবে সড়ক ব্যবহার করবে তাও জানাতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি লিফলেট, ব্যানার ও ফেস্টুন লাগাতে হবে।
তিনি বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের সকল সদস্যের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। আবার হকারদের মাধ্যমে সড়কের ফুটপাতগুলো দখল হয়ে যাওয়ার কারণে পথচারীরা হাঁটতে রাস্তায় নেমে যায়। সড়ককে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে নিরাপদ রাখা সম্ভব নয়। এ বিষয়গুলো আমাদেরকে ভাবতে হবে।
এর আগে বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস এম মনজুরুল হক চালক-মালিকদের উদ্দেশে বলেছেন, আপনি মালিক, আপনি কার হাতে গাড়ি তুলে দিচ্ছেন, কোন ড্রাইভারকে গাড়ি দিচ্ছেন, তার সঠিক ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না- এসব আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে। এসব নিশ্চিত না করে দৈনিক আড়াই হাজার, তিন হাজার টাকার জন্য লাইসেন্সবিহীন কারও হাতে গাড়ি তুলে দিলে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। প্রয়োজনে চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে আপনাদের। সবকিছু সরকারের উপর তুলে দিলে হবে না। বিআরটিএর দায়িত্ব পাওয়ার পর ব্যক্তিগতভাবে মেয়রের সঙ্গে দেখা করি। তাকে চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে জেব্রা ক্রসিং করে দেওয়ার অনুরোধ জানাই। তিনি কথা রেখেছেন। বিভিন্ন পয়েন্টে জেব্রা ক্রসিং করে দিয়েছেন।
একই বিষয় নিয়ে সিডিএ চেয়ারম্যানের সঙ্গেও দেখা করি। তাকে চট্টগ্রামের কিছু পয়েন্টে ফুটওভার ব্রিজ করে দেওয়ার অনুরোধ জানাই। সেখান থেকে বলা হয়, জিইসি এবং মুরাদপুরে দুটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা যাবে। এসব কথা ছয় মাস আগের। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেটার বাস্তবায়ন আমরা দেখিনি। চট্টগ্রাম শহরে ফুটপাত দিয়ে হাঁটার কোনো উপায় নেই। ফুটপাত বেদখল হয়ে আছে। তাহলে পথচারীরা কোথায় হাঁটবে? তাদেরকে বাধ্য হয়েই রাস্তায় ঝুঁকি নিয়ে হাঁটতে হচ্ছে।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, কেউ কখনো দুর্ঘটনা কামনা করে না। আইন প্রয়োগ করে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারে সারাজীবনের কান্না। অধিক আয় করতে গিয়ে যদি নিজের জীবন হারিয়ে ফেলেন, তাহলে তো সবশেষ। আপনি (ড্রাইভার) প্রাণ হারালে গাড়ির মালিক হয়তো কয়েকদিন আপনার পরিবারের খবর নেবেন। পরবর্তীতে আপনার পরিবারের খবর আর কেউ নেবে না। তাই সকলের সচেতন হয়ে গাড়ি চালানো উচিত। ট্রাফিক বিভাগ যতক্ষণ পর্যন্ত সঠিকভাবে কাজ করবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত সড়কে বিশৃঙ্খলা থেকে যাবে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায়, ভুয়া লাইসেন্স, কানে মোবাইল ফোন রেখে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটবেই। এব্যাপারে প্রত্যেক গাড়ির চালককে সতর্ক থাকতে হবে। অদক্ষ, অযোগ্য ও নেশাগ্রস্ত চালক দ্বারা গাড়ি চালানো যাবে না। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। দুর্ঘটনা ও যানজট কমাতে টার্মিনাল নির্মাণে শুধু উদ্যোগ গ্রহণ করে বসে থাকলে হবে না। আলোচনা করতে হবে, সংশ্লিষ্ট সকলকে একযোগে বসে কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। লোভ কমিয়ে এবং প্রতিযোগিতা বন্ধ করে গাড়ি চালাতে হবে। নিরাপদ সড়ক ও জীবন নিশ্চিত করতে হলে সহজ শর্তে চালকদের জন্য লাইসেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিআরটিএ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (ইঞ্জি.) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে আবৃত্তিকার ফারুক তাহের ও ফারহীন মাহমুদ খানের সঞ্চালনায় সেমিনারে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াউল হক মীর, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু, মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব বেলায়েত হোসেন বেলাল ও জেলা সড়ক পরিবহন বাস-মিনি বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অলি আহমদ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন, বিআরটিএ, চট্ট-মেট্রো-২ সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) উসমান সরওয়ার আলম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআরটিএ, চট্টগ্রাম জেলা সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) এমডি শাহ আলম। এর আগে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি প্রধান প্রধান সড়ক ঘুরে পুনরায় এলজিইডি ভবনে এসে শেষ হয়।
| M | T | W | T | F | S | S |
|---|---|---|---|---|---|---|
| 1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 |
| 8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 |
| 15 | 16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 |
| 22 | 23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 |
| 29 | 30 | 31 | ||||
