আদালত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেয়া জামিনের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির দ্বিতীয় দিনও তুমুল হৈ চৈ, চিৎকার, চেচামেচি হয়েছে । এক পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, তিনি শুনানি করবেন না।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনও এক পর্যায়ে বিরক্তি প্রকাশ করে এজলাস ছেড়ে চলে যেতে চান। তিনিও বলেন, ‘এভাবে চলছে কাযর্যক্রম চালানো সম্ভব নয়।’ পরে আইনজীবীরা নিবৃত্ত হন।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যাওয়া খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে আপিল করেন ১৯ ফেব্রুয়ারি। ২২ ফেব্রুয়ারি শুনানিতে আপিল গৃহীত হলে ২৫ ফেব্রুয়ারি হয় জামিন শুনানি। ১২ মার্চ বিএনপি নেত্রীকে চার মাসের জামিন দেয় হাইকোর্ট। আর এর বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ এবং দুদক।
এই আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয় মঙ্গলবার। প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির প্রথম দিনই রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের বক্তব্যে হৈ চৈ করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। দ্বিতীয় দিন হট্টগোলের পরিমাণ ছিল আরও বেশি।
এদিন বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, খন্দকার মাহবুব হোসেন, মওদুদ আহমদ, জয়নুল আবেদিন ও মাহবুব উদ্দিন খোকন বক্তব্য রাখেন। তারা সবাই খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়ার বিষয়ে নানা যুক্তি তুলে ধরেন।
আইনজীবীদের দাবি, হাইকোর্ট কাউকে জামিন দিলে আপিল বিভাগের হস্তক্ষেপের নজির নেই। খালেদা জিয়াকে বিচারিক আদালতে সাজা দেয়াও ঠিক হয়নি বলেও দাবি করেন তারা। সেই সঙ্গে তার শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি তুলে ধরেন আইনজীবীরা।
এই মামলায় খালেদা জিয়ার আইনজীবীরাই রাষ্ট্রপক্ষকে পক্ষভুক্ত করলেও রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য রাখা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এরপর বক্তব্য দেন দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান এবং সব শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল তার বক্তব্য রাখা শুরু করেন। তার তিন কথা বলা শুরুর পর পরই শুরু হয় হট্টগোল।
অ্যাটর্নি জেনারেল শুরুতেই তার সমালোচনা করে বিএনপির আইনজীবীদের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।’
তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা তো প্রশ্ন তুলিনি। জবাব দেওয়ার দরকার নেই। আপনি যুক্তি খণ্ডন করেন।’
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মশিউর রহমানের জামিনের বিরোধিতা না করার বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্যের জবাব দেন অ্যাটর্নি জেনারেল। বলেন, ‘মশিউর রহমানের মামলা এবং খালেদার মামলার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ মামলায় রাষ্ট্রের টাকা চুরি করা হয়েছে।’
তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা সমস্বরে প্রতিবাদ জানান।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘রাষ্ট্রের টাকা নিয়ে গিয়েছে, এটা বলতে পারব না? এটা আমাকে বলতে হবে।’
এ সময় আরও তীব্র চেচামেচি শুরু করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘হৈ চৈ করে আমাকে কথা বলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি উত্তেজিত হবেন না। জবাব দিন।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘মেরিটে যাব না। হৈ চৈ চলতে থাকায় আমার পক্ষে এ অবস্থায় শুনানি করা সম্ভব নয়। কাল শুনানি হোক।’
এ সময় চিৎকার আরও বেড়ে যায়। খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের পাশাপাশি রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তারাও পাল্টা চিৎকার করতে থাকেন।
এ পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির দৃাষ্ট আকর্ষণ করে মাহবুব উদ্দীন খোকন বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল তার আইন কর্মকর্তাদের উত্তেজিত হওয়ার জন্য ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাদেরকে উঠতে ইশারা দিয়েছেন।’
খোকনের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান কয়েকজন আইন কর্মকর্তা। এ সময় তুমুল হৈ চৈ শুরু হয়।
এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি এজলাস থেকে নামতে উদ্যত হন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘দলবল নিয়ে এসেছে (বিএনপির আইনজীবীরা) আদালতকে চাপ সৃষ্টির জন্য।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘উভয়পক্ষের আইনজীবীরা এমন করলে কোর্ট চালানো সম্ভব নয়।’
পরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মামলার কিছু তথ্য তুলে ধরেন। শেষ পর্যায়ে বলেন, ‘তিনটি মামলায় জামিন হয়েছে (দুদকের মামলায় উচ্চ আদালতে), সেখানে সুনির্দিষ্ট কারণ দেখানো হয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়ারটাই কারণ দেখানো হয়নি।’
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার বিষয়ে মাহবুবে আলম বলেন, ‘বাস্তবতা হলে, এটা প্রধানমন্ত্রীর এতিম ফান্ড। এটা বেসরকারি বা ব্যক্তিগত ট্রাস্ট নয়। তাই মামলা করে দুদক যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছে।’
অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে খালেদা জিয়াকে জামিন দিতে তার আইনজীবীদের আর্জি খণ্ডন করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এই রোগ নিয়েই তিনি রাজনীতি করে আসছেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। এটা তার সহনীয়। এ যুক্তিতে জামিন হতে পারে না।’
‘আপিল বিচারাধীন থাকাবাস্থায় এভাবে জামিন হতে থাকলে দেখা যাবে সবাই জামিন নিয়ে চলে যাবে। সাজা ভোগ করতে হবে না। এভাবেই ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা পরিত্যক্ত হয়ে যাবে।’
এরপর আদালত বলেন, আগামী মঙ্গলবার (১৫ মে) রায়।
