খালের অংশ বিশেষ দখলও নয়। এবার খালের পাড় নয়। একেবারে খালের তিনভাগের দুইভাগ দখল। খুব দ্রুততার সাথে ভাড়াঘর ও দোকান দাঁড়িয়ে গেছে! নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। মালিকের নির্দেশে বেশ তাড়াহুড়া করছে নির্মাণ শ্রমিকরা। অবৈধ এ দখল পুরোপুরি সম্পন্ন করতে ভাড়াঘর (পাকা) ও দোকানের উপর শুধু টিন লাগানো বাকী রয়েছে। টিন লাগানোর কাজও চলছে বেশ দ্রুতগতিতে। ১৭ নম্বর রোডের সৈয়দশাহ রোডস্থ ওয়াপদার পাশে চাকতাই খালের শাখা খালে দিনেদুপুরে এসব অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিন ওই এলাকার গিয়ে দেখা গেছে, একেবারে খালের উপরেই এসব স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। সাংবাদিকদের ছবি তোলা ঠেকাতে রীতিমত পাহারা বসানো হয়েছে অবৈধ স্থাপনার সামনে।
স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মোরশেদ নামে সাতকানিয়ার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি এসব অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলছেন। এ দৃশ্য দেখলে যে কারো মনে হতে পারে, খাল দখলে যেন মোরশেদের কোন লুকোচুরি নেই। কোন রাখঢাক নেই। ফ্রি স্টাইলে চালানো হচ্ছে এ দখল প্রক্রিয়া। জানা গেছে, নগরীর খালসমূহের দুই পাড় থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে গঠিত ‘টাস্কফোসের্র’ অস্তিত্ব আছে। কিন্তু নড়াচড়া নেই। গঠনের পর থেকে টাস্কফোর্স এ পর্যন্ত কোন উচ্ছেদ অভিযানও পরিচালনা করে নি। এছাড়া প্রতি মাসে কমপক্ষে একটি সভা করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও সেটা মানা হয় না। এমন পরিস্থিতিতে নগরীর খালগুলোর দুই পাড়ের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়ায় খাল দখল করে নতুন নতুন স্থাপনা গড়ে তুলছে অবৈধ দখলদাররা। উল্লেখিত ঘটনা তারই প্রমাণ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বর্ষায় অল্পবৃষ্টিতেও নগরীতে যে জলাবদ্ধতা হয় তার অনেকগুলো কারণেরও একটি এই খাল দখল। কারণ অবৈধ স্থাপনার মাধ্যমে সংকুচিত হয়েছে খালের প্রশস্ততা। যা খালের পানি ধারণ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে এবং বিঘ্ন ঘটায় স্বাভাবিক পানি চলাচলেও। ফলে দ্রুত পানি প্রবাহ না হওয়ায় খালের আশপাশের এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। আগামী বর্ষায় নগরবাসীকে জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি দিতে খালের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের মাধ্যমে খালের গতিপথ বাড়ানো উচিত বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রণীত মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী নগরীতে মোট ৫৭টি খাল রয়েছে। যার মোট দৈর্ঘ্য ১৬৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এক তালিকা থেকে জানা গেছে, চাক্তাই খালের দুইপাড়ে ৪৮জন এবং রাজাখালী খালের পাড় দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছেন ৬৮ জন দখলদার। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তালিকা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহরের ২২টি খালে ১৩৫টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। তবে তালিকার বাইরেও নগরীর প্রায় প্রতিটি খালের দুইপাড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রাকৃতিক খালসমূহ থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়মিত মনিটরিং করার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করেছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সরেজমিন দেখা গেছে, ওয়াসা ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানের আলোকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন অবৈধ দখলদারদের একটি তালিকা করেছিল। তালিকা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহরের ২২টি খালে ১৩৫টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এসব স্থাপনার মধ্যে একতলা থেকে শুরু করে আটতলা ভবন পর্যন্ত রয়েছে। রয়েছে টিনশেড ঘর, দোকান, টয়লেট, স’মিল, সেমিপাকা ঘর, পানির ট্যাংক, ভবনের গেট, বাউন্ডারি ওয়াল, মসজিদ, মার্কেট ও স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
নগরীর বালুখালী খালে ৩টি, বামনশাহী খালে ৩টি, বির্জাখালে ১৬টি, চাক্তাই ডাইভারশন খালে ৪টি, চাক্তাইখালে ২টি, ডোমখালী খালে ৫টি, গুপ্তখালে ৪টি, খন্দকিয়া খালে ১৩টি, কৃষ্ণাখালী খালে ১০টি, কুয়াইশ খালে ৫টি, মহেশখালে ১০টি, মির্জাখালে ৩টি, মোগলটুলী খালে ৫টি, নাসিরখালে ৭টি, নিজাম মার্কেট খালে ২টি, নোয়াখালে ৯টি, পাকিজা খালে ২টি, রাজাখালী খালে ৬টি, রামপুর খালে ১৭টি, সদরঘাট খালে ৪টি, টেকপাড়া খালে ২টি, ত্রিপুরা খালে ৩টি এবং শীতলঝর্ণা খালে ১টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে।
এসব অবৈধ স্থাপনার সাথে যুক্ত হয়েছে উল্লেখিত দোকান ও ভাড়াঘর।
এ বিষয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর একেএম জাফরুল ইসলাম জানান, এ খালের উপর নির্মিতব্য অবৈধ স্থাপনাগুলো সম্পর্কে ইতোমধ্যেই সিটি করপোরেশনে রিপোর্ট করেছি। সার্ভেয়ারও এ সংক্রান্তে প্রতিবেদন দিয়েছেন। এখন সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, খালের জায়গায় যার মালিকানাই থাকুক, পানির গতিরোধ করে স্থাপনা নির্মাণ কোন আইনে সমর্থন করে না। সিটি করপোরেশন কেন এতদিন চুপ করে থেকেছে এটাই প্রশ্ন।
