হাইপোথিটিকাল বা অনুমাননির্ভর বিষয় লেখার উপজীব্য হতে পারে যদি তা হয় কল্পকাহিনি। গল্প-উপন্যাস-কবিতা এক বিষয়, রাজনীতি বা চলমান বিষয়ে লেখা আরেক। আমাদের আটকে পড়া সময়ে এখন রাজনীতিও অনুমাননির্ভর বিষয়ের ওপর ভর করতে চায়। কারণ মুক্তি ও জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে তা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছিলাম সেদিনই এদেশের মাথার ওপর থেকে ছাদ চলে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুতে পিতাহীন দেশের যেসব অভিভাবক হাল ধরতে পারতেন তাদের একসঙ্গে খুন করার পর দেশের রাজনীতি হয়ে উঠেছিল ছাদহীন ঘরের অবারিত লীলাভূমি। আজ এত বছর পর আমরা বুঝতে পারছি তার জের ও দায় কত ব্যাপক।
এখন একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে বঙ্গবন্ধু থাকলে কি এই সব সমস্যার জন্ম হতো? আজ যে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা তা কি থাকত? বা এভাবে জাঁকিয়ে বসে আমাদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করতে সাহস পেতো? এর জবাব দেওয়া সহজ নয়। কারণ এতে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার ইমেজে কোনো কালিমা লেপন বা খারাপ দাগ পড়ার কারণ নেই। তবে মনভোলানো উত্তরে এটা বললে কোনো লাভ হবে না যে, এমনটা হতো না। বাংলাদেশ কোনো একা বিচ্ছিন্ন দেশ নয়। তার ওপর বিশ্বায়ন বা দুনিয়ার চাপ পড়তই। আমাদের প্রতিবেশী দেশ তাদের রাজনীতি সব মিলিয়ে কি হতো কি হতো না বলা মুশকিল।
কিন্তু এটা বলা যায় তিনি থাকলে তাঁর ছায়া ও তেজে দেশ-জনগণ নিরাপদ ও সচেতন থাকত। এমন নেতা তো আর জন্মায়নি, হয়ত জন্মাবেও না কোনোকালে। যাঁকে একনজর দেখলেই মানুষের মনে শান্তি নেমে আসত। তাঁর ক্যারিশমাই এমন তাঁর পায়ে অস্ত্র জমা দিতে পারাটাই সশস্ত্রের চেয়ে বড় সাহস। এটা আমরা দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধারা করেছিলেন। তাছাড়া তিনি বেঁচে থাকলে আমরা রাজনীতিতে অনেকটাই স্বনির্ভর হয়ে উঠতাম। জামায়াতের বাড়াবাড়ি করার সুযোগই থাকত না। আর বিএনপির জন্ম হওয়ারই দরকার পড়ত না। এতসব হতো কি হতো নার পরিণতি ১৫ আগস্ট। সে রাতে এদেশের সাহস ও শৌর্যের পতন ঘটায় আজ রাজনীতির এই বেহাল দশা।
যদি আমরা জঙ্গিবাদের কথা বলি তার ইন্ধন বাইরের হলেও ভেতরে আছে বিষফোঁড়া। তিনি বেঁচে থাকলে এরা মাথাচাড়া দিতে পারত না। কারণ তিনি নিজেই এক হিমালয়। এ কারণে আঁচ কম হতো বটে তার মানে এই না জঙ্গিবাদ থাকত না। মনে করুন, বায়াত্তর-তিয়াত্তর সালে বাম-ডানের ঝগড়া। মনে করুন কমিউনিস্টদের নামে সন্ত্রাস। সিরাজ সিকদার। এগুলো যেমন ছিল আজকের জঙ্গিরাও থাকত। তিনি চাইলেই সিরিয়া লিবিয়া বা আফগানিস্তানে শান্তি আসত? দুনিয়ার মোড়ল বনাম ধর্মের এ লড়াই এড়াতে পারত না তাঁর দেশ। তবে যেটা হতো তিনি যেহেতু মহীরুহ তাঁর ছায়ায় নিরাপদবোধ করত জনগণ।
এটা মনে রাখা দরকার বঙ্গবন্ধুর সময়েই এদেশে প্রথম মূর্তি ভাঙা শুরু হয়। কিশোরবেলার সে দুঃসহ ঘটনার জের এখন স্বাভাবিক ঘটনার মতো হয়ে গেলেও ভোলা মুশকিল। একজন জাতীয় নেতা মাথার ওপর থাকেন আলোর মতো। তিনি পথ দেখান কিন্তু অন্ধকার বা উপদ্রব ঠেকানো তাঁর কাজ নয়। যেমন গাঁধী পারেননি দাঙ্গা ঠেকাতে। আগেও বলেছি এর সঙ্গে তাঁর ইমেজের কোনো সম্পর্ক নেই। আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে চোরাস্রোত যে ভয়াবহতা তার কারণ আওয়ামী লীগও আগের জায়গায় নেই। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগে নিয়ে আসা দলটি জনকহীন বলেই মাঝেমধ্যে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করে। এটাই তাঁর না থাকার কুফল। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা যেতেন জনগণের কাছে। সে কারণে আমেরিকা চীনকেও ভয় পেতেন না। এখনকার রাজনীতি রাজদূতের কাছেই অসহায়।
বঙ্গবন্ধু থাকলে কি হতো কি হতো না তারচেয়ে বড় কথা তাঁকে মেরে ফেলার ভেতর দিয়ে খুনের রাজনীতি শুরু। এ কারণে মনে করি তাঁর আত্মার অভিশাপও হয়ত বা চলমান। শুদ্ধ হওয়ার একটাই পথ। অমন শুভ্র পোশাক অমন সাদাসিধে জীবন অমন তেজ আর দেশপ্রেম। আছে তা আমাদের?
লেখক : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কলামিস্ট
