মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেছেন কর্ণফুলী পাড়ের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যাপারে সব ধরনের সংশয়ের কথা নাকচ করে দিয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক গর্জনের চেয়ে বর্ষণ বেশিই হবে। কোনো অবৈধ দখলদারই কর্ণফুলীর পাড়ে থাকবে না। হয় তারা নিজেরা যাবে, অন্যথায় আমরা গুঁড়িয়ে দেব।
জেলা প্রশাসক বলেন, জেলা প্রশাসনের সাথে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আছে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আছে, পুলিশ আছে, র্যাব আছে, বিজিবি আছে। সর্বোপরি মহামান্য হাই কোর্টের রায় আছে। চট্টগ্রামের আপামর মানুষের ভালোবাসা এবং সদিচ্ছা আছে। সুতরাং এই উচ্ছেদ অভিযান ব্যর্থ হতে পারে না।
মহল বিশেষ উচ্ছেদ অভিযানকে ভণ্ডুল করতে চায়, বিভ্রান্তি ছড়াতে চায় বলে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, তারা হুমকি দিয়েছে, ধমকি দিয়েছে। ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টাও করেছে। কিন্তু কোনোকিছুকেই আমরা পরোয়া করি না।
কর্ণফুলী পাড়ের উচ্ছেদ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দৈনিক আজাদীর সাথে সাক্ষাৎকারে জেলা প্রশাসক এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমাকে হুমকি দিয়ে লাভ নেই। আমি ভয় করি না। ম্যাজিস্ট্রেট থাকা অবস্থায় ঝিনাইদহে চাকরি করেছি। সর্বহারা পার্টির ক্যাডাররা হুমকি দিয়েছে। ইটভাটায় পুড়িয়ে লাশ গুম করবে বলে শাসিয়েছে। কাফনের কাপড় পাঠিয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুকেই পাত্তা দিইনি। অবৈধ বহু স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছি। ইটভাটায় অভিযান চালিয়েছি।
তিনি বলেন, তখন তো অনেক ছোট ছিলাম। এখন বুড়ো হয়েছি। এখন আর হুমকি দিয়ে কিছু হবে না। কোনো কিছুকে ভয় পাওয়ার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি।
দৈনিক আজাদীকে তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট। আমরা কর্ণফুলীর পাড়কে দখলদারমুক্ত করব। হাতিরঝিলের মতো করে কর্ণফুলীর পাড়েও পর্যটনের বিকাশ হবে। চট্টগ্রামের মানুষ অবসরে সময় কাটাবে। সৌন্দর্য দেখার জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে হবে না। কর্ণফুলীর পাড়েই সৌন্দর্য পিপাসুদের মনের ক্ষুধা মিটানোর অবকাঠামো গড়ে উঠবে।
জেলা প্রশাসক হাই কোর্টে রিট আবেদনকারী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, তিনি যদি হাই কোর্টে ওই রিট না করতেন, তাহলে আমরা এভাবে উচ্ছেদ করতে পারতাম না। এখানে স্থানীয়ভাবে উচ্ছেদ করতে গেলে বহু মামলা মোকর্দমার সৃষ্টি হতো। উচ্ছেদ কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ত। এখন আমাদের হাতে মহামান্য হাই কোর্টের রায় আছে। এখন আমাদেরকে থামানোর শক্তি আর কারো নেই।
প্রভাবশালী মহলের চাপ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, চাপ তো থাকবে। তবে আমাদের রক্ষাকবচ হচ্ছে হাই কোর্টের রায়। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে পজেটিভ চাপ আছে। উচ্ছেদ অভিযান দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করার জন্য তাগাদা আছে। মাননীয় ভূমিমন্ত্রী আমাদের সাথে আছেন। মাননীয় শিক্ষা উপমন্ত্রীও আমাদের সাথে আছেন। উচ্ছেদ অভিযান ত্বরান্বিত করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। কর্ণফুলীর পাড়কে দখলদারমুক্ত করার ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা আছে। অতএব, এই উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে ইলিয়াস হোসেন বলেন, আমাদের কিছু বাজেট সংকট আছে। উচ্ছেদ অভিযানের পরপরই পিলার পুঁতে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা দিতে পারলে সুবিধা হতো। তবে এখনি আমরা তা পারছি না। বন্দর কর্তৃপক্ষকে আমরা অনুরোধ করেছি দখলদারমুক্ত জায়গা ঘিরে ফেলার জন্য। একই সাথে বন্দর কর্তৃপক্ষ যাতে নতুন করে কোনো জায়গা কারো কাছে লিজ না দেয় সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে। আমরা এখন উচ্ছেদ করব। দখলদারমুক্ত করব। পরবর্তীতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বিভিন্ন ব্যক্তির তদবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেকেই তদবির করতে এসেছেন। নিজেদের কোটি কোটি টাকার স্থাপনা, সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা বলতে এসেছেন। আমরা তাদের কথা শুনেছি। বলেছি, অবৈধভাবে কেন নদী দখল করে স্থাপনা বানিয়েছিলেন? কে বলেছিল? এখন আপনারা নিজেরা নিজেদের স্থাপনা ও সম্পদ সরিয়ে নিন। তাতে আপনাদেরই লাভ হবে। আমরা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিলে কিংবা স্ক্যাভেটর দিয়ে ভেঙে আনলে আপনাদের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে। আমরা তাদেরকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি, নদীর পাড়ে কোনো অবৈধ স্থাপনা থাকবে না। হয় আপনারা নিজেরা সরাবেন, না হয় আমরা গুঁড়িয়ে দেব।
উচ্ছেদ অভিযানের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, আমরা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে ইকুইপমেন্ট নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছি। আমাদের কাছে কোনো সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ইকুইপমেন্ট নেই। আমরা বুলডোজার দিয়ে ছোটখাটো স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দিতে পারছি। বড় বড় ভবনগুলো ম্যানুয়ালি ভাঙতে হচ্ছে। এতে অনেক সময় লাগছে। খরচও অনেক। আমরা যদি বড় এবং কার্যকর ইকুইপমেন্ট পেতাম, তাহলে বড় বড় অবৈধ স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দিতে সুবিধা হতো। ঢাকা থেকে বড় ইকুইপমেন্ট আনার ব্যাপারে যোগাযোগ করছেন বলেও জানান তিনি।
পৃথিবীর নানা দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, নদীর পাড়ই দুনিয়াতে মহামূল্যবান জায়গা। অথচ কর্ণফুলীর পাড় মারাত্মক অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আমার স্বপ্ন, এই নদীর পাড়ে হাতিরঝিলের মতো কিংবা আরো সুন্দর অবকাঠামো গড়ে উঠবে। ওখানে কোনো গাড়ি চলবে না। লোকজন হাঁটবে, বসে গল্প করবে। চাঁদনী রাতে মানুষ প্রকৃতির মাঝে নিজেদের বিলিয়ে দেবে। ওখানে আমাদের সন্তানেরা খেলবে। ছোটাছুটি করবে, সাইক্লিং করবে। এই স্বপ্ন খুব বড় নয়। এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন খুব কঠিন নয়।
সদরঘাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত নদীর পাড়ে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে জেলা প্রশাসক বলেন, সিটি কর্পোরেশন এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারে। অথবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও পুরো এলাকার চেহারা পাল্টে দিতে পারে। কিংবা পর্যটন কর্পোরেশন করতে পারে অনন্য এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন। যে করুক না কেন, তাতে চট্টগ্রামের মানুষেরই উপকার হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করার পর আর কোনো প্রকল্পের টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার সময় বাংলাদেশ পার করে এসেছে। দেশের অর্থনীতি অন্য উচ্চতায় অবস্থান করছে।
প্রসঙ্গত, দখলে, দূষণে বিপর্যস্ত কর্ণফুলী নদী। নদীর দুই পাড়ে নানা নামে নানা প্রতিষ্ঠান দখল করে রেখেছে দীর্ঘদিন ধরে। বিচ্ছিন্নভাবে দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হলেও তাতে সুফল আসেনি। দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে হাই কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ২০১০ সালের ১৮ জুলাই একটি রিট করেন। ওই রিটের প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট চূড়ান্ত রায় দেন। এতে আরএস জরিপ অনুযায়ী কর্ণফুলীর উভয় পাড়কে দখলদারমুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
হাই কোর্টের রিটের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন নদীর দুই পাড়ে অবৈধ স্থাপনার ব্যাপারে ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর একটি রিপোর্ট প্রদান করে। কর্ণফুলীর দুই পাড়ে ২ হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়।
এসব অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো ধরনের সংশয় নেই উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক আজাদীকে বলেন, আমরা শুরু করেছি। আমাদেরকে শেষ করার সময় দিতে হবে। গর্জনের পর বর্ষণ দেখার জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়।
| M | T | W | T | F | S | S |
|---|---|---|---|---|---|---|
| 1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 |
| 8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 |
| 15 | 16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 |
| 22 | 23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 |
| 29 | 30 | 31 | ||||
