আমার ইউকে সফরও প্রায় শেষ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শেষ। ঢাকার যানজট, তীব্র গরম, লোডশেডিং, কাদা, ধুলা, হাঁটু পানি; মনে হচ্ছে এসব বড্ড মিস করেছি গত ২৫ দিনে। চির চেনা ঢাকায় ফিরে যাব, তর সইছে না! লন্ডনের আভিজাত্যে যে হাঁপিয়ে উঠেছি!
এদের তো এখানে রীতিমতো সোনায় সোহাগা অবস্থা। বাসা ভাড়া বাবদ, সন্তান, শিক্ষা ভাতা ইত্যাদি মিলে চারজনের একটা পরিবার বাংলাদেশি টাকায় লাখ দুয়েক টাকা সরকার থেকে পাচ্ছেন প্রতি মাসে। এর বাইরে কাজও করছেন।
তারা জানান, এখানে খুব ভালো থাকলেও বাংলাদেশের দুর্দশায় তাদের মন কাঁদে। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের হতাশা, অভিযোগের শেষ নেই। ক্রিকেট ছাড়া অন্য কিছুতে আদৌ বাংলাদেশের কোনও সম্ভাবনা আছে কিনা, এ ব্যাপারে তারা ঘোরতর সন্দিহান। কারও কারও অভিমত, বাংলাদেশ জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়া হতভাগা এক জনপদ। যেখানে পর্যাপ্ত খাবার নেই, মানুষের জীবনের মূল্য নেই। কোনোকিছু নেই। আমি বাংলাদেশের নানা ইতিবাচক দিক এবং সম্ভাবনা তুলে ধরেও তাদের আশ্বস্ত করতে পারিনি।
যাদের আবার এই দেশে জন্ম, লেখাপড়া এবং বড় হওয়া তারা তো একেবারেই অন্যরকম। বাংলাদেশ অথবা বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে তাদের বেশিরভাগেরই কোনোরকম আগ্রহ নেই। এরা বাংলা বলতে পারেন না, এমনকি জীবনে একবার বাংলাদেশেও আসেননি। এরা চুটিয়ে ব্রিটিশ লাইফ উপভোগ করছেন।
এই ক’দিনে ইংল্যান্ডে বেশ কিছু বাংলাদেশি ভাইয়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে আমার। মোস্তাক সাহেব তাদের একজন। বাঙালিরা যে এতো পরিশ্রমী, এতো বিনয়ী হতে পারে, মোস্তাক সাহেবের সঙ্গে পরিচয় না হলে জানা হতো না।
একদিন বিকালে তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, ‘আজ আমার বাসায় আপনার ইফতারের দাওয়াত। আমি আপনাকে নিতে আসব।’ তিনি ব্যবসা করেন, নিজের কিছু ব্যবসাপাতি আছে জানতাম, কিন্তু তিনি যে এতোটা ধনী সেটা বোঝার উপায় ছিল না।
যেতে যেতে জানলাম, গোটা তিনেক লেটেস্ট মডেলের মার্সিডিজ গাড়ি আছে তাদের। বাসায় ঢুকে তো আমি তো পুরোপুরি হতভম্ব, মাথা খারাপ হবার যোগাড়। ‘এটা কি বাসা, নাকি ফাইভ স্টার হোটেল?’ মোস্তাক সাহেব হাসলেন। দোতলা বাড়ি। এর সঙ্গে ফাইভ স্টার হোটেলকে মেলানো যায় না।
তবে বাংলাদেশে যে কয়েকটা ফাইভ স্টার হোটেল আছে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি সুসজ্জিত, গর্জিয়াস মোস্তাক সাহেবের বাড়িটি। কি তার ডাইনিং, কি তার ড্রয়িং, কি তার কিচেন রুম! রীতিমতো অবিশ্বাস্য, বলে বোঝানোর উপায় নেই। বেড রুম তো নয়, যেন স্বর্গ! আমি বললাম, ‘ভাইজান, আপনার বাসার ছবি তুলব। ঢাকায় ফিরে স্টোরি করব।’ মোস্তাক সাহেব বললেন, ‘না না। কী দরকার আছে?’
সুবিশাল ডাইনিং টেবিল। সেখানে সাজানো ২৫-৩০ ধরনের খাবার। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিলো। বললাম, ‘ভাইজান, আমি গরিব, সাধারণ মানুষ। আমার জন্য এতো কিছু কেন?’ তিনি বললেন, ‘আপনি তো আজ আমার মেহমান, তাই না? আসলে এতো ব্যস্ত থাকি যে, কারও আতিথেয়তা করার সময় হয়ে ওঠে না।’
একটু পরে তার স্ত্রী, ডাক্তার মেয়ে এবং ইঞ্জিনিয়ার ছেলে আসলেন। তারাও রোজা রেখেছেন। তারা সেভাবে বাংলায় কথা বলতে পারেন না। তবে বুঝতে পারেন। ইফতার ও নামাজ শেষ করে আমরা সবাই ড্রয়িং রুমে বসলাম।
মোস্তাক সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাইজান, আপনি এতো ধনী হলেন কীভাবে?’ তিনি তার জীবনের ইতিহাস বলতে শুরু করলেন। জানালেন, শৈশবে এবং কৈশোরের বেদনাদায়ক দিনগুলোর কথা। এমনও দিন গেছে যে, একবার চুলাও জ্বলেনি তার বাড়িতে। বললেন, কীভাবে তিনি অল্প বয়সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন। এসব কাহিনী যখন বলছিলেন, তখন তার দুই সন্তানের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিলো।
‘আরে আমি তো স্ল্যামডগ মিলিয়নিয়ারের বাবা। আমার কাছে স্ল্যামডগ মিলিয়নিয়ার নাথিং। আমি তাদের এসব কষ্টের দিনগুলোর কথা বলি এ কারণে, তারা যেন অতীত ভুলে না যায়। তাদের যেন মনে থাকে, তার বাবা কোথা থেকে এসেছে। তার পরিচয় কি, তার ধর্ম কি। ওরা লেখা পড়া শেষ করেছে। ওদের কখনও কাজ করতে দেইনি। ওদের কখনও কাজ করা লাগবেও না। আমি যা রেখে যাচ্ছি, তা যদি ঠিকমতো দেখে রাখতে পারে তাহলে ওদের ৫০ প্রজন্মের চলে যাবে।’
‘বাংলাদেশ আমাকে দারিদ্র্য ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। তবুও ওই দেশকে আমি বড্ড মিস করি। সময় পেলে ছুটে যাই। ঘুরে আসি। আমি ক্রিকেট খুব ভালো বুঝি না। তারপরও মাঠে খেলা দেখতে গেছি। অনেককে টিকিট কিনে দিয়েছি। আমার দেশের ছেলেরা এখানে এসেছে। আমার মন বড় অস্থির হয়ে উঠছিল। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হলে খুব খুশি হতাম।’
আমি বললাম, ‘ভাইজান, সামনে তো সময় আছে। নিশ্চয়ই বাংলাদেশ একদিন চ্যাম্পিয়ন হবে। মন খারাপ করবেন না। মাশরাফিদের সামনে আপনারা তো প্রেরণা হিসেবে আছেনই। আপাতত আপনারাই আমাদের চ্যাম্পিয়ন।’
