নতুন করে হবিগঞ্জ জেলার আরও এক নারী একইভাবে সাহায্য চেয়েছেন। সম্প্রতি সুমি আক্তার নামে পঞ্চগড়ের একজন নারী সৌদি আরব থেকে লুকিয়ে ভিডিও কল করে তাকে উদ্ধারের করার জন্য আকুল আবেদন জানান। সেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পরার পর বাংলাদেশে বেশ তোলপাড় হয়েছে।

সৌদি ফেরত নারী শ্রমিকদের কাছ থেকে নির্যাতনের এরকম বেশ কিছু কাহিনি প্রকাশিত হওয়ার পর সেদেশে আর নারীদের পাঠানো উচিত কি না সে নিয়ে বিতর্ক জোরদার হয়েছে।

নারী শ্রমিকদের সুরক্ষায় সরকারের ভাবনা

সরকারের বক্তব্য হলো – নারী শ্রমিকদের সৌদি পাঠানো বন্ধ করাটা ঠিক হবে না এবং এখনই এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি বলছে, নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়, বরং সৌদি আরবে নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন কীভাবে বন্ধ করা যায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

কিন্তু সুরক্ষার ব্যাপারে কী ধরনের প্রস্তাব করছে বাংলাদেশ?  এই কমিটির সভাপতি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলছেন, ‘যেটা করা দরকার, সেখানে যে নির্যাতন হয় সেই নির্যাতন বন্ধের জন্য যারা এমপ্লয়ার তাদের যেন একটা আইনি বাধ্যবাধকতা থাকে এবং তারা যদি কোনো নির্যাতন করে তাহলে তাদের যাতে আইনের মুখোমুখি হতে হয় তার বন্দোবস্ত করা।’

তিনি বলছেন, এই মুহূর্তে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি দল সৌদি আরব রয়েছেন নারী শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়টি আলাপের জন্য। আজই (বুধবার) একটি বৈঠক হওয়ার কথা।

তবে সৌদি আরবের মতো রক্ষণশীল একটি দেশে চাকরিদাতার আবাসস্থলে পর্যন্ত গিয়ে নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা কীভাবে দেবে বাংলাদেশ সেই ব্যাপারে কোনো কর্মপরিকল্পনা বা প্রস্তাব বাংলাদেশে দিয়েছে সেটি পরিষ্কার করে বলেননি মাহমুদ।

সৌদি আরবের দিক থেকে চাপের কারণে কী বাংলাদেশ কোনো কঠোর অবস্থান নিচ্ছে না? তার জবাবে তিনি বলেন সেটি কোনো ইস্যু নয়।

সৌদি আরবে নারী শ্রমিক না পাঠানোর বিকল্প কী আছে?

অভিবাসন সম্পর্কে গত প্রায় ৩০ বছরের হিসাব পাওয়া যায় জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কাছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে এই সময়কালে নারী শ্রমিকদের ৪০ শতাংশের গন্তব্য ছিল সৌদি আরব।

শুধু এবছর অক্টোবর পর্যন্তই প্রায় ৫৪ হাজারে মতো নতুন নারী শ্রমিক সেখানে গেছেন। দ্বিতীয় প্রধান গন্তব্য জর্ডানের তুলনায় সৌদি আরবে নারী কর্মী যাওয়ার প্রবণতা প্রায় চারগুণ বেশি।

২০১৫ সাল থেকে অনেক বেশি মাত্রায় নারী শ্রমিকরা বিদেশে যেতে শুরু করেন যখন শ্রমিক পাঠানোর ব্যাপারে দীর্ঘদিনের কড়াকড়ি তুলে নিয়েছিল সৌদি আরব। বাংলাদেশ সরকার গৃহ-শ্রমিক পাঠানোর ব্যাপারে সৌদি আরবের সাথে একটি চুক্তি করেছিল, যার শর্ত ছিল একজন নারী শ্রমিক পাঠানো হলে দুইজন পুরুষ শ্রমিক নেয়া হবে। বলা হচ্ছে, লিখিত হলেও এই চুক্তি এখন আর মানা হচ্ছে হচ্ছে না।

সরকারি হিসাবেই সৌদি আরবে ২০ লাখের মতো পুরুষ শ্রমিক আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে এবছর অক্টোবর পর্যন্ত অভিবাসী শ্রমিকেরা এক লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছে যার একটি বিশাল অংশ সৌদি আরব থেকে এসেছে।

নারী শ্রমিক না পাঠালে পুরুষ শ্রমিকের ভাগ্যও কি হুমকিতে পড়বে? সৌদি আরবে নারী শ্রমিক না পাঠানোর কোনো বিকল্প কি আছে? বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলছেন, ‘বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা সৌদি আরব যেতে চান কারণ বড় একটা জনসংখ্যা যারা লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি, যাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা অনেক বেশি দুর্বল, তারা কায়িক পরিশ্রম করে টাকা আয় করতে চায়। বাংলাদেশের গরিব অসহায় নারীদের জন্য যদি আমি শ্রমবাজার চিন্তা করি তাহলে সেটা সৌদি শ্রমবাজার।”

তবে তিনি বলছেন, ‘নতুন শ্রমবাজারও তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই জাপানে নার্স, বয়স্ক ও অসুস্থদের সেবা দেয়ার জন্য কর্মী এবং শিশুদের যত্ন নেয়ার জন্য ন্যানি পাঠাচ্ছে। নারী শ্রমিকরা হংকং ও সিঙ্গাপুরেও যাচ্ছে।’

কিন্তু তিনি একই সাথে এই কথাও বলছেন যে নারীদের নতুন যেসব শ্রমবাজার অল্প কিছুদিন হলো তৈরি হয়েছে অর্থাৎ জাপান, হংকং ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশে শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমিকদের চাওয়া হচ্ছে। অদক্ষদের জন্য ঐসব দেশে তেমন সুযোগ এখনো নেই।

নির্যাতন, ধর্ষণ মৃত্যু

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের কুলসুম বেগম সৌদি আরবের আল কাসিম অঞ্চলে কাজে গিয়েছিলেন এই বছরের মার্চে। কিন্তু ছয় মাসের মাথায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। নির্যাতনের কারণে কাজ করতে চাননি বলে স্থানীয় রিক্রুটিং এজেন্সিতে তাকে ফেরত দিয়ে যান সৌদি গৃহকর্তা।

কাজ করতে চাননি বলে এজেন্সির লোকেরা সেখানে তাকে আটকে রেখে যে নির্যাতন চালিয়েছে তার বর্ণনা দিয়ে কুলসুম বেগম বলেন, ‘আমারে বুট জুতা দিয়ে ইচ্ছামতো মুড়াইছে। লাথি মারছে, গালের মধ্য চড়াইছে। আমি বুকের পাঁজরে আঘাত পাইছি। লাথিতে আমার কিডনিতে সমস্যা হইছে।’

কুলসুম বেগম কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলছিলেন, তার ঘরে বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়েছিলো তার চাকরিদাতা। তাই গরমে ফ্যানও চালাতে পারেননি।

ফিরে আসার বিমান ভাড়া আর চিকিৎসায় অনেক অর্থ খরচ হয়ে গেছে। তার আত্মীয়রা দেনা করে বিমানের ভাড়া দিয়েছেন। যে ছয় মাস তিনি ছিলেন তার জন্য কোনো অর্থ তিনি পাননি।

মানিকগঞ্জের ফাতেমা বেগম দুই বছর সৌদি আরবে কাজ করে তিন মাস হলো দেশে ফিরেছেন। তিনি বলছেন, ‘খালি মারধোর করতো। খাইতে দেয়া হতো না। প্রতিদিন দুপুর বেলা চুরি কইরা রুটি খাইতাম। এটা নিয়ে পরে তাদের সাথে ঝগড়া করলাম। পুলিশের কাছে যাওয়ার পর তারা আমার কাজের বাসা বদলাইয়া দিছে। সেখানেও সারাক্ষণ কাজ করাইতো। কোনো বিশ্রাম নিতে দিতো না। তাই দেশে চলে আসছি। আর যাবো না ওরকম মানুষের দেশে।’

এই বছরের প্রথম দশ মাসে সৌদি আরব থেকে সাড়ে নয়শ’রও বেশি নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন বলে অভিবাসন বিষয়ক সংস্থাগুলো বলছে। শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতনে অভিযোগ নিয়ে এসেছেন তারা। বেতন বা খেতে না দেয়ার অভিযোগতো রয়েছেই।

এছাড়া অভিবাসী কল্যাণ সংস্থাগুলোর হিসাবে এ বছরই সৌদি আরব থেকে ৪৮ জন নারী গৃহকর্মীর মৃতদেহ দেশে আনা হয়। এর মধ্যে অনেকেই আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

মরদেহ ফিরিয়ে আনার পর সেগুলো ময়নাতদন্ত করা হয়েছে কি না এমন কোনো তথ্য নেই।

মানিকগঞ্জের সিংগাইর এলাকার মঙ্গল খান বলেন, দুই মাস আগে স্ত্রীর মরদেহ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে রিয়াদে গৃহকর্তার বাসায়।তিনি বলছেন, ‘ওখানকার পুলিশ বলছে আত্মহত্যা করছে। তারা ফ্যানের সাথে লাশ ঝুলানো পাইছে। ওই দিন এক বাঙালি আমারে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছে আপনার কি সৌদিতে কোনো আত্মীয় আছে? আমি বললাম আমার স্ত্রী। আমাকে বলল সে মারা গেছে। ফ্যানে ঝুলতাসে।’

স্ত্রীর আত্মহত্যার বিষয়টি বিশ্বাস করছেন না মঙ্গল খান, কারণ নানা সময়ে ফোনে নির্যাতনের কথা তার স্ত্রী তাকে জানিয়েছেন। স্ত্রীর মরদেহ গত দুই মাস যাবত রিয়াদে মর্গে পড়ে রয়েছে বলে তিনি জানেন। -বিবিসি বাংলা

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031