চট্টগ্রামের মুখ্য বিচারিক হাকিম মুন্সী মো. মশিউর রহমান পুলিশের চেকপোস্টে বাইরের মানুষ দিয়ে তল্লাশি হচ্ছে জানিয়ে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ।
শনিবার বিকেলে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসী কনফারেন্সে তিনি এই আহ্বান জানান।
চট্টগ্রামের মুখ্য বিচারিক হাকিম বলেন, ‘আপনারা সারাদিন-রাত কাজ করেন। বিশেষ করে অফিসার ইনচার্জ (ওসি) যারা আছেন, আপনারা অনেক রাত ঘুমাতেও পারেন না। আপনারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন, অনেক ঝামেলার মধ্যে কাজ করেন। তারপরও আপনাদের কিছু কিছু অনিয়ম আমাদের চোখে পড়ে। রাস্তায় চলতে-ফিরতে অনেক সময় দেখি এসব।’
নিজের দেখা পুলিশের চেকপোস্টের বর্ননা দেন এই বিচারক, ‘আমি নিজেই সম্মুখীন। থানার নাম আমি বলবো না। বাসে করে যাচ্ছি, তল্লাশির জন্য পুলিশ গাড়ি থামিয়েছে। দেখা যায় সাদা পোশাকে কয়েকজন লাঠি হাতে পুলিশের সাথে দাঁড়িয়েছে। তারা আমার কাছে আসে তল্লাশি করতে। তখন জানতে চাই, আপনারা কারা? বলে, পুলিশের লোক। বলি, আইডি কার্ড দেখান। বলে, আইডি কার্ড নাই। আইডি কার্ড লাগবে কেন? আপনি কে?’
সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন বিচারক মুন্সী মো. মশিউর রহমান আরও বলেন, ‘সাদা পোশাকে থাকা ওই লোকদের আমি বললাম, আপনারা আমাকে তল্লাশি করতে চাচ্ছেন, পুলিশ পরিচয় দিচ্ছেন আর আইডি কার্ড দেখাবেন না? আপনার টিমের প্রধানকে ডেকে নিয়ে আসেন। এরপর দেখি একজন এএসআই আসেন।’
পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের মুখ্য বিচারিক হাকিম বলেন, ‘বাইরের মানুষ পুলিশের সাথে মিশে তল্লাশি করছে। এতে করে পুলিশ বাহিনীর ইমেজের ক্ষতি হচ্ছে। র্যাবের সাথেও দেখা যায় সাদা পোশাকে মানুষজন। দয়া করে এসব করবেন না। এগুলো করলে আপনাদের ইমেজের ক্ষতি হয়, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলার ক্ষতি হয়। পরিচয় চাইলে দয়া করে নিজেদের পরিচয় দেবেন। পোশাক পরিধান করে দায়িত্ব পালন করবেন। যারা ডিবিতে আছেন, ডিবির পোশাক পরবেন। তা না হলে বিভ্রান্ত হবে মানুষ।’
মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে পুলিশ বিভাগের ভূমিকার প্রশংসা করে সভাপতির বক্তব্যে চট্টগ্রামের মুখ্য বিচারিক হাকিম মুন্সী মো. মশিয়র রহমান বলেন, ‘সাক্ষীর প্রতি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারীর ক্ষেত্রে মামলার ধার্য্য তারিখের আগে কোন সাক্ষীকে পুলিশ খুঁজে পেলে ধার্য্য তারিখের বিজ্ঞ আদালতে হাজির থাকার শর্তে থানার অফিসার ইনচার্জ জামিন দিতে পারেন। অজামিন যোগ্য পরোয়ানার ক্ষেত্রে নির্ধারিত তারিখের আগে যে কোন দিন সাক্ষীকে বিজ্ঞ আদালতে হাজির করতে পারবেন।’
থানায় ধারণ ক্ষমতার অধিক মামলার আলামত জমে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মামলা নম্বর উল্লেখ করে আলামত বিনষ্ট বা নিষ্পত্তির করার জন্য মূখ্য বিচারিক আদালত বরাবরে আবেদন করতে হবে। আবেদন পেলে এক সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি করা হবে।’
সভায় মেডিক্যাল সার্টিফিকেট প্রসঙ্গে একাধিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘সময় মত মামলার মেডিক্যাল সার্টিফিকেট পাওয়া না গেলে আসামির জামিনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়। পূর্বে নির্দেশ থাকা সত্বেও মেডিক্যাল সার্টিফিকেট বড় হাতের অক্ষরে হেচ্ছে না। চট্টগ্রগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তুলনায় উপজেলার মেডিক্যাল সার্টিফিকেট লেখার মান অত্যন্ত নিম্ন। তবে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট সরবরাহ ব্যবস্থা অতীতের চেয়ে উন্নত হয়েছে।’
দন্ড বিধির ৩২৬ ধারায় উল্লেখিত ৮টি ক্ষেত্রের ক্ষেত্র ব্যতীত মেডিক্যাল সার্টিফিকেট বা পুলিশ প্রতিবেদনে ‘গ্রিভিয়াস হার্ট’ শব্দটি লেখার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
দীর্ঘদিন ধরে থানায় পরে থাকা গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রসঙ্গে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে যথাযথ কারণ উল্লেখ করে ‘নন-এক্সিকিউশন’ রিপোর্ট আদালতে প্রেরণ করতে হবে। কী কারণে আদেশ কার্যকর করা যাচ্ছে না তাতে উল্লেখ করতে হবে। থানায় গ্রেফতারি পরোয়ানা পড়ে থাকলে পুলিশের দূর্নাম হয়।’
উপস্থিত চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে মুন্সী মো. মশিউর রহমান বলেন, দন্ডপ্রাপ্ত আসামির সাজা শেষ হওয়ার পর সাজা পরোয়ানা আদালতে প্রেরণ করা হয় না। ফলে আইনানুগ জঠিলতা সৃষ্টি হচ্ছে।
সি.আর মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা অবহেলা করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত সমাপ্ত করতে না পারলে সময় বর্ধিত করার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আদালতে দরখাস্ত দিতে হবে। কোন কোন মামলায় সাক্ষীদের ১৬১ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করে সাক্ষীদের প্রতি জারী করা ১৬০ ধারার নোটিশসহ প্রেরণের নির্দেশ দিলেও তা মানা হচ্ছে না। ১৬৭ ধারায় উল্লেখিত সময়ের মধ্যে তদন্ত সমাপ্ত করতে না পারলে আসামি জামিন পেতে পারেন উল্লেখ করে তিনি।’
মামলার জব্দ তালিকা ঘটনাস্থলে কমপক্ষে দুইজন স্থানীয় সাক্ষীর উপস্থিতিতে হাতে লিখে তৈরী করার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, গুরুতর আহত করার মামলায় রক্তমাখা ভিকটিমের কাপড় চোপড় জব্দ করতে হবে। আগুনে পোড়ার মামলায় আগুনে পোড়া ছাইসহ বিভিন্ন আলামত জব্দ করার সুযোগ রয়েছে।
কনফারেন্সে চট্টগ্রামের মুখ্য বিচারিক আদালতের বিচারকবৃন্দ ও চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নুরেআলম মিনার নেতৃত্বে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারবৃন্দ ও সকল থানার ওসি, চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী, চট্টগ্রামের জেলা পিপি সিরাজুল ইসলাম, জেলা আইজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু হানিফ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
