ফিস্টুলায় আক্রান্ত বাংলাদেশে ৭০ হাজারের বেশি নারী। প্রতিদিনই এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আর বাড়ার বহরে গতি জোগাচ্ছে ভুল অস্ত্রোপচারজনিত ফিস্টুলা। দেশে প্রতিবছর দুই থেকে তিন হাজার নতুন ফিস্টুলা রোগী যোগ হচ্ছেন। বছরে তিন শতাধিক রোগীকে অপারেশন করান চিকিৎসকরা। এনজেন্ডারহেলথ্ বাংলাদেশের ‘ফিস্টুলা কেয়ার প্রকল্প’র গবেষণা প্রতিবেদন মতে, প্রতি হাজার বিবাহিত নারীর বিপরীতে বাংলাদেশে ফিস্টুলা আক্রান্ত নারীর সংখ্যা ১ দশমিক ৭ জন।
সূত্র জানায়, ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বছরে ২৫০ থেকে ৩০০ ফিস্টুলা রোগী সেবা নিচ্ছেন। এখানে আগে ১৬টি বেড ছিল। কিন্তু দিন দিন রোগীর সংখ্যা বাড়ার কারণে বর্তমানে বেড সংখ্যা বাড়িয়ে ৩৫ উন্নীত করা হয়েছে। অন্যদিকে, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) সি-ব্লকে ৬টি বেড নিয়ে আলাদাভাবে ফিস্টুলা সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে গত ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে এ সেন্টার থেকে রোগীদের সেবা দেয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, অসচেতনতার কারণে মূলত নারীরা ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশ শিশু মৃত্যুর হারে সাফল্য অর্জন করলেও নিরাপদ প্রসব এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। অসতর্কতা, মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া, অদক্ষ দাইয়ের হাতে সন্তান প্রসব, সঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছে না যাওয়া এবং পরিবারের অবহেলার কারণে এখনো দেশের অনেক মা প্রসবকালীন সময়ে সঠিক সেবা পান না। ফলে নারীরা ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
গত ১৯ বছর ধরে ফিস্টুলা রোগে ভুগছেন আকলিমা। এখন বয়স ৪৬ বছর। প্রথম বাচ্চা সিজার করতে গিয়ে এই রোগের সৃষ্টি হয়। একটি বেসরকারি ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এই রোগের সৃষ্টি। প্রসব ব্যথা ওঠার ৫ দিনের মাথায় ক্লিনিকে নেয়া হয় তাকে। ততক্ষণে পেটের বাচ্চাটিও মারা যায়। এরপর আর সন্তান হয়নি আকলিমার। তিনি বলেন, কোনো ছেলেমেয়ে নেই। স্বামী তাকে সহযোগিতা করছেন।
চিকিৎসকদের মতে, ফিস্টুলা একটি নিরাময়যোগ্য শারীরিক সমস্যা। দক্ষ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এ সমস্যা নিরাময় সম্ভব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা অপারেশনের মাধ্যমে ফিস্টুলা ঠিক করা যায়। বাল্যবিয়েকে নারীজনিত ফিস্টুলার অন্যতম কারণ বলা হয়। বাল্যবিয়ে বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কম বয়সে গর্ভধারণ করলে ফিস্টুলা হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই উপযুক্ত পদ্ধতি গ্রহণ করে পরিণত বয়সে সন্তান নেয়া উচিত। উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর সহায়তায় প্রসব করালে ফিস্টুলা ঝুঁকি কম থাকে। বাধাগ্রস্ত প্রসবের ক্ষেত্রে দ্রুত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জাতীয় ফিস্টুলা সেন্টারসহ দেশের ১১টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে ফিস্টুলা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ঢাকা এবং যশোরের আদ-দ্বীন হাসপাতালে, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতালে এবং দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ল্যাম্বসহ ৮টি বেসরকারি হাসপাতালে এনজেন্ডারহেলথ্? ফিস্টুলা রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে। ঢাকায় এই রোগীদের জন্য একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রও পরিচালিত হচ্ছে। সূত্র জানায়, নগরের ১৮/২ বকশীবাজারে প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগী চিকিৎসা, আরোগ্য ও পুনর্বাসন প্রকল্পের কার্যালয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ইউএনএফপিএ’র সহায়তায় পরিচালিত প্রকল্পের আওতায় এ পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২৮ জন নারীর থাকার ব্যবস্থা আছে। কেন্দ্রের ভেতরেই বেকারি, সেলাই, রান্না, সবজির বাগান তৈরি, হাঁস-মুরগি পালনসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার ব্যবস্থা আছে। প্রশিক্ষণ পেয়ে এক সময়ে সমাজচ্যুত এই নারীরা এখন অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী।
ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. ফেরদৌসি ইসলাম লিপি জানান, বাড়িতে বাধাগ্রস্ত প্রসব কমাতে দরকার দক্ষ ধাত্রী। তাহলে ফিস্টুলা কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রসবের সঠিক সময়ে পাটোগ্রাফ ব্যবহার করতে হবে। থাকতে হবে পূর্ব প্রস্তুতিও। মানুষের মধ্যে সচেতনতাই পারে এ রোগ থেকে মুক্তি দিতে। বিলম্বিত প্রসব রোধ করতে মায়েদের পার্শ্ববর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করতে হবে। তিনি আরো বলেন, বাধাগ্রস্ত ফিস্টুলা কিছুটা কমলেও গাইনোকোলজিক্যাল অস্ত্রোপচারে বাড়ছে ফিস্টুলা। এজন্য চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ পরিস্থিতিতে ২৩শে মে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি নানা আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্ব ফিস্টুলা দিবস পালন করা হবে।
