এক বছর দেশের অর্থনীতির জন্য ২০২০ সাল ছিল সংকটময় চ্যালেঞ্জের । দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়ার পর এ বছর চার মাসের বেশি সময় উৎপাদন কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ ছিল। ফলে অর্থনৈতিক কার্যকর্মে দেখা দেয় স্থবিরতা। ভঙ্গুর হয়ে পড়ে অর্থনীতি। একমাত্র রেমিট্যান্স ছাড়া প্রায় অর্থনীতির সব সূচকে ধস নামে। এতে গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে ৫.২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ। যে কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি পাল্টে যায় বাংলাদেশের অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশও। একদিকে জীবনরক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা, অন্যদিকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লড়াই-এই দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ। করোনার প্রভাবে দেশের অর্থনীতি যে ক্ষতির শিকার হয়েছে, সেই ধকল অনেকটাই কেটে উঠেছে বাংলাদেশ। তবে এখন পুরো দমে গতি ফেরেনি। সূত্র মতে, সরকার বিভিন্ন ধাপে মোট ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩.৭ শতাংশ। ওদিকে করোনার ভেতরে গত ১১ই জুন যে বাজেট ঘোষণা করে সরকার, তাতেও অর্থনীতি গতিশীল করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়।
অর্থনীতিবিদরা জানান, প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাদের মতে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় এগোচ্ছিল। কিন্তু করোনায় এ অর্জনে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। সময়মতো প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করায় সামলে উঠছে পরিস্থিতি এবং সঠিক পথেই এগুচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। পুরোপুরি সুফল পেতে হলে আরো সময় অপেক্ষা করতে হবে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা এবং সাধারণ মানুষের জীবিকার কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন শর্ত পালন ও নির্দেশনা মানা সাপেক্ষে আবার ৩১শে মে থেকে অফিস খুলে দেয় সরকার। ধীরে ধীরে খুলে দেয়া হয় গণপরিবহনও।
রপ্তানি আয়: করোনা-পরবর্তী গত জুন পর্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে ছিল দেশের রপ্তানি খাতও। এরপর থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিশেষ করে রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ অবদান রাখা এই খাত। সবশেষ চলতি অর্থবছরে নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি বা আয় বেড়েছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৪ শতাংশ।
রিজার্ভ, রেমিট্যান্স ও রাজস্ব: করোনা-পরবর্তী অর্থনীতির দুটি সূচকে অভাবনীয় সাফল্য লক্ষণীয়। ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারে (৪২ বিলিয়ন) পৌঁছেছে। প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে, নভেম্বরও রেকর্ড রেমিট্যান্স এসেছে। সরকারের প্রধান আয়ের উৎস রাজস্ব আহরণ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় থাকলেও অক্টোবর এবং নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হয়েছে।
শিল্পোৎপাদন: গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশের উৎপাদন খাত সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল। সাবান, ডিটারজেন্টসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী, ওষুধসহ হাতেগোনা কয়েকটি পণ্যের উৎপাদন বাড়লেও অন্য সব শিল্পপণ্যের উৎপাদনে ব্যাপক ধস নামে। বেশির ভাগ কলকারখানা বন্ধ ছিল কিংবা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্পপণ্য হিসেবে তৈরি পোশাককে ধরা হয়। গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত তিন মাসে সেই তৈরি পোশাকের উৎপাদন অর্ধেকের বেশি কমেছে।
ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি: করোনাভাইরাসের কারণে সব খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ইতিবাচক। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫.২৪ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। আর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৬৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, কৃষিখাত, কল-কারখানায় শ্রমিকদের কাজে ফেরা, সঠিক পথে রেমিট্যান্সের পাঠানো অব্যাহত ছিল বলে প্রবৃদ্ধি হার ইতিবাচক ছিল।
তেজি পুঁজিবাজার: দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়ার পর দীর্ঘ সময় উৎপাদন কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল। এরমধ্যেও দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক চলতি বছর পর্যন্ত ৬৭৪ পয়েন্ট বেড়েছে। ২০১৯ সালের শেষ দিন ডিএসই’র মূল সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৪ হাজার ৪৫৩ পয়েন্ট। ২৪শে ডিসেম্বর তা বেড়ে ৫ হাজার ২১৮ পয়েন্টে উঠেছে। লেনদেন হচ্ছে হাজার কোটি টাকার ঘরে।
ভ্যাট মেশিনের যুগে এনবিআর: বরাবরের মতোই বিদায়ী বছরেও রাজস্ব আদায় এবং করফাঁকি রোধে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পদক্ষেপগুলোর একটি আধুনিক প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি), যা মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ফাঁকি রোধ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে তা আদায় সহজ করতে চালু করা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের ইতিবাচক প্রভাব অবশ্যই আছে। এর ফলে প্রাণ ফিরেছে অর্থনীতির। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও সামাজিক সুরক্ষায় আরো বেশি নজর দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ঋণনির্ভর এই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কিছু সমস্যার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। অবশ্য ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট মহলের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এরইমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্যাকেজের আকার স্ফীত এবং ঋণ বিতরণের শর্ত শিথিল করেছে সরকার। তারপরেও ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত কৃষিঋণ, নিম্ন আয় ও প্রান্তিক চাষি, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট স্কিমসহ অন্যান্য খাতে ঋণ বিতরণের চিত্র সন্তোষজনক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত এসএমই খাতের ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৪৯ শতাংশ ছাড় হয়েছে। অথচ বড় ব্যবসায়ীদের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকার তহবিলের পুরোটাই এরইমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আরো একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষিত হতে পারে। ব্যবসায়ীরা দাবি তোলার এ বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
