আরব-ইসরায়েলের পুরনো শত্রুতার অবসানে তৈরি হচ্ছে নতুন বিন্যাস। সংঘাত ও বৈরিতার জনপদ মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপট আমূল বদলে যাচ্ছে।  সামরিক ভারসাম্যেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। রাজনৈতিক মেরুকরণের নতুন চেহারা দেখা যাচ্ছে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের ভূগোলে।

২০২০ সালের শুরুতেই মার্কিন হামলায় ইরানি জেনারেল সুলাইমানি নিহত হওয়ার ঘটনায় নতুন করে উতপ্ত হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য। ইরান-সিরিয়া-ইয়েমেন-হামাসের সামরিক শক্তির ‘মাস্টার-মাইন্ড’ জেনারেল সুলাইমানির হত্যার প্রতিক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ও সংঘাতের আশঙ্কা করা হয়। বেশ কিছুদিন টানটান উত্তেজনা চললেও করোনাভাইরাসের ভয়ানক বিস্তারের ফলে স্তিমিত হয় উভয় পক্ষের  সামরিক হুঙ্কার। খোদ যুক্তরাষ্ট্র, ইরান মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ায় সবার নজর চলে যায় গ্লোবাল পেন্ডেমিক করোনার দিকে।
কিন্তু করোনাকালের সঙ্কুল পরিস্থিতিতেও আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেমে থাকেনি। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-সিরিয়ার নেতৃত্বে ‘শিয়া ক্রিসেন্ট’ বা শিয়া ইসলামের শক্তি সঞ্চয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত সুন্নিপন্থী সৌদি ও তার মিত্রদের নিয়ে তৎপর হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিনীদের প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক শাসকগণ আগে থেকেই অনুগত ও নির্ভরশীল। গুরুত্বপূর্ণ সামরিক নেতা জেনারেল সুলাইমানিকে হত্যা করে মার্কিনীরা ইরান-সিরিয়ার বিরুদ্ধে সৌদিপন্থীদের আরো বিশ্বাসভাজন হয় ও আরো কাছে চলে আসে। আরব নেতাদের নির্ভরশীলতাও বাড়ে মার্কিনীদের প্রতি।
যার প্রমাণ মেলে কয়েক মাসের মধ্যেই, যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক-রাজনৈতিক মেরুকরণে বিরাট পরিবর্তন আসে। নিজেদের মধ্যে লড়াই করলেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছিল মারমুখী ও একাট্টা, তারাই এখন একে একে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আলিঙ্গন করেছে ইহুদি রাষ্ট্রটিকে। এমনটি সম্ভব হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পদক্ষেপের কারণে। মাত্র তিরিশ দিনের মাথায়  ট্রাম্প সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর দ্বিতীয় উপসাগরীয় ও চতুর্থ আরব দেশ বাহরাইনকে ইসরায়েলের মিত্রে পরিণত করেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এই ‘ঐতিহাসিক’ ও ‘যুগান্তকারী’ ঘটনার পুরো কৃতিত্ব ডোনাল্ড ট্রাম্পের। কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট যা পারেননি, তিনি সেটাই করে দেখিয়েছেন। ইরানবিরোধী মেরুকরণের মাধ্যমে সৌদি অনুগত দেশগুলোকে একে একে ইসরায়েলের সঙ্গে বৈরিতার পর্যায় থেকে মৈত্রীর বন্ধনে নিয়ে আসছেন তিনি। মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে সঙ্গে আরো মিত্র ও অনুগত তৈরি করেছেন তিনি। অদূর ভবিষ্যতে আরো উপসাগরীয়-আরব দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা । কারণ অধিকাংশ দেশই, বিশেষত ওমান, কাতার ও সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের ‘আনঅফিশিয়াল’ সম্পর্ক রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির ফর্মুলা দিয়ে ট্রাম্প পরিণত হয়েছেন আরব-ইসরায়েল বন্ধুত্বের নবনির্মাতায়, যা তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের অন্যতম দাবিদার রূপে দাঁড় করিয়েছে। এই ঘটনা ট্রাম্পকে আসন্ন নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিতেও সাহায্য করবে বলে পর্যবেক্ষকগণ মনে করছেন। মঙ্গলবার ১৫ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি ও সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি বাহরাইনের সাক্ষরের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক কাঠামোর বদলই শুধু হবেনা, বরং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইমেজ ও উচ্চতাও অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে, যা তার সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতাকে চাপা দিয়ে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে উজ্জ্বলতর করবে।
১৯৪৭/৪৮ সালের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান আরব-ইসরায়েল সংঘাত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্যোগে অনেকাংশে কমবে এবং আরব-ইহুদি মৈত্রীর মতো অকল্পনীয় বিষয়ও বাস্তবে রূপ লাভ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি ও তার মিত্রদের বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, এমনকি সামরিক নৈকট্য বৃদ্ধির সম্ভাবনাও রয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটাবে।
কিন্তু মার্কিন-ইসরায়েল-সৌদি ত্রিভুজের মধ্যকার  মৈত্রী ও মেরুকরণ মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপট বদলে দিলেও এবং কোনো কোনো দেশ বা শাসকের জন্য লাভ বয়ে আনলেও তা সামগ্রিকভাবে আরব তথা মুসলিম বিশ্বের দেশ ও জনগণের মধ্যে পূর্ণ নিরাপত্তা ও শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম জগত ঐতিহাসিকভাবেই চারটি শক্তিকেন্দ্রে ও দু’টি মতাদর্শে বিভক্ত। প্রধান মতাদর্শিক বিভেদ শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে, যা ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকেই রক্তাক্ত ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে এবং বর্তমানে ইরান-সৌদি বৈরিতার মাধ্যমে তীব্রভাবে দৃশ্যমান রয়েছে।  আর চারটি শক্তিকেন্দ্রের চারদিকে আছে চারটি জাতিগোষ্ঠী: ১. আরব, ২. তুর্কি, ৩. ইরানি, ৪. কুর্দি। ইসলাম সবার মধ্যে কমন-আইডেন্টিটি হলেও মধ্যপ্রাচ্যের ইসলাম-পরবর্তী দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে এই চারটি শক্তিই পুরো অঞ্চলে কখনো কখনো কর্তৃত্ব ও শাসন করেছে, পরস্পরে যুদ্ধ-বিগ্রহ করেছে এবং কেউই কারো আনুগত্য মেনে নেয়নি।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ও ইসরায়েল জোটের সঙ্গে মিলে সৌদি জোটের শক্তি বৃদ্ধি পেলেও তা পূর্ণ শান্তির প্রতিশ্রুতি দিতে পারবেনা। এক্ষেত্রে ইরান, তুরস্ক ও কুর্দিদের মনোভাব আর প্রতিক্রিয়া কেমন হয়, সেটাও বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে বৈকি। এটা ঠিক যে, বদলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপট, তবে সেই বদলের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে এখনই শেষ কথা বলার সময় আসেনি।
ড. মাহফুজ পারভেজ: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031