নাগরিক শ্রেণি বিভাজন নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে সমাজের মূল প্রতিনিধিত্ব যে মধ্যবিত্তরাই করে সেটা অনস্বীকার্য। সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্বীয় সংজ্ঞা আর আমাদের চোখে দেখা মধ্যবিত্তের মধ্যে ফারাক আকাশপাতাল। সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি-চেতনায় প্রতিনিধিত্বের হিসেবে এরাই আমাদের সমাজের মেরুদন্ড। কথা হলো এই মধ্যবিত্ত কারা? তাদের চেনার উপায় কী?

এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি আসলে আমাদেরই মধ্যে লুকিয়ে আছে। এদের দেখলে চেনা যায় না। এদেরকে খুঁজে নিতে হয়। এরা চাল নিতে রেশনের লাইনে দাঁড়ায় না। কম মূল্যে পেয়াজ-তেলও কিনতে যান না লজ্জায়। বরং পেঁয়াজ ছাড়াই একটা সপ্তাহ চালিয়ে দেওয়াকে এরা উত্তম মনে করে। এরাই আমাদের মধ্যবিত্ত। এই যে তাদের ঘরে পেঁয়াজ নেই, কিংবা তেল। তাদের ঘরে অনটন আছে। কিন্তু সেটাই তাদের প্রাইভেসি অন্য অর্থে আত্মমর্যাদা।

এই আত্মমর্যাদাশীল মধ্যবিত্ত সবশ্রেণির মানুষের মধ্যেই আছে। আগে সরকারি কর্মকর্তাদেরকেও মধ্যবিত্ত বলা হতো। তাদেরও অভাব থাকতো। থাকতো জীবনের টানাপোড়েন। তাই নিয়ে তারা জীবনযাপন করে এসেছেন।

এই কথার সত্যতা আমার নিজের দাদা সরকারি চাকুরে আর এসডিও দাদাশ্বশুর মাজেদ মিয়ার গল্প শুনে বুঝেছি। মাজেদ মিয়া সামান্য টাকার জন্য তার ছেলেকে স্কাউটে পাঠাতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। অবসরে যাওয়ার পর ডেপুটি নির্বাচন কমিশনারও হয়েছিলেন তাও অরর্থনৈতিকভাবে ফুলে ফেঁপে উঠেননি। তার সেই ছেলেও বড় হয়ে এটমিক এনার্জি কমিশনের পরিচালক হয়েছিলেন। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়ার মানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্বামীর সহকর্মী হওয়ার সুবাদে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্টজন হয়েছেন। কিন্ত তিনিও বাবার মত আঙুল ফুলে কলাগাছ হননি। নিজেকে নিতান্তই সাধারণ মানুষ মনে করা মানুষটা, এখনও সততা আর শৈশবের অর্থনৈকি- টানাপোড়েন এর গল্প বলতে গর্ববোধ করেন। যেটা বলছিলাম, বর্তমান সময়ে এসে এমন অভাবী মধ্যবিত্ত সরকারি কর্মকর্তার খোঁজ মিলবে না। কারণ কর্মকর্তারা এখন আর মধ্যবিত্ত নন। তাই বলে মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে উধাও হয়ে গেছে তা-ও নয়। যাদের প্রয়োজন আছে কিন্তু সেটা পূরণের সাধ্য সীমিত তাদের মধ্যে আছে, বেসরকারি স্কুল ও কলেজের শিক্ষক, কিছু সেক্টরের সরকারি চাকুরে, ধর্মীয় গুরু, ছোট উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক, গার্মেন্ট শ্রমিক, দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক।

অনেক শ্রমজীবি আছেন যারা হাত পাততে পারেন না। কিন্তু বাসায় রান্নার চাল নেই। করোনা পরিস্থিতিতে এই ধরণের মধ্যবিত্তরাই এখন বেশি সংকটে। এরা কারও কাছে হাতও পাততে পারবে না, আবার রাজনৈতিক নেতাদের পিছু পিছু ঘোরাও সম্ভব না। ফলে এরাই এই সংকটে সবচেয়ে বেশি সুবিধাবঞ্চিত।

করোনা সঙ্কটে সরকারের তরফ থেকে সধারণ মানুষের কাছে ত্রাণ সেবা পৌঁছানোর অনেক রকম চেষ্টা চলছে। হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আসছে অসহায়দের জন্য। কিন্তু সংকটে পড়া মধ্যবিত্তরা এসব ত্রাণ পাচ্ছেন কি-না সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করে লেখাটা শেষ করি। আমার এক কাছের ছোটভাই ফোনে জানালো, সে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে দরখাস্ত করেছিলো সাহায্যের জন্য। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তার চাল সংগ্রহ করতে। কিন্তু ইউনিয়ন অফিস তাকে বরাদ্দের সেই চাল দেয়নি। বিষয়টা জানতে পেশাগত পরিচয়ে আমি ইউএনওকে ফোন করি। সংশ্লিষ্ট ওই ইউনিয়ন থেকে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করে যারা সরকারি সাহায্য পেয়েছে তাদের তালিকাটা চাই উনার কাছে। ইউএনও সেই তালিকা দিতে রাজি হলেন। তবে তিনি এটাও বললেন, জেলা প্রশাসক বরাবর তাদের আবেদনের ভিত্তিতেই ইউনিয়ন অফিসে যাচাইবাছাই করতে দেওয়া হয়েছে সেই তালিকা।এলাকার মেম্বার-চেয়ারম্যান আবেদনকারী ব্যক্তিকে উপযুক্ত মনে করলে দেবে, মনে না করলে দেবে না।

অর্থাৎ সেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান যে কি-না নিরুপায় হয়ে গোপনে সাহায্য পেতে চাইলো সেটা আর গোপন থাকলো না। ইউনিয়ন থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হলো। মানসম্মানের কথা ভেবে সে আর প্রতিবাদও করতে পারলো না।

বাস্তবতা হলো মধ্যবিত্তের পোশাকি নাম পাওয়া অনেক বিত্তহীন, নির্লোভ মানুষ আসলেই সংকটে পড়েছে। মূল স্রোত হিসেবে এরাই সমাজের প্রাণপ্রবাহ টিকিয়ে রেখেছে। আজ যখন তারাই সংকটে তাদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। অন্তত মানুষ হিসেবে মানুষের ভালোবাসা-সহমর্মিতা তাদের প্রাপ্র। এই মধ্যবিত্তদের খালি চোখে দেখা যায় না। এদের খুঁজে বের করতে হয়। আমি আপনি জানি আমাদের আশপাশে সংকটে রয়েছেন কারা। আসুন তাদের পাশে দাঁড়াই। লেখক: সংবাদকর্মী

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031