পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিহীনতার কারণে মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীরা নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে আদিবাসী পল্লীগুলো। পীরগঞ্জের আদিবাসী পল্লীগুলোতে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল ঘনিয়ে এলেই মোটরসাইকেল, অটোরিকশা-ভ্যানযোগে দূর-দূরান্ত থেকে আগমন ঘটে ওইসব মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের। আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই মেলে তাদের নিজস্ব তৈরিকৃত চোলাই মদ। আর এ চোলাই মদের আড়ালে চলছে গাঁজা, ইয়াবা ও ভারতীয় নিষিদ্ধ ফেনসিডিলের রমরমা ব্যবসা। মাদকের সহজলভ্যতার কারণে যেমনি উঠতি বয়সের যুব শ্রেণি ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সহজেই মাদকে আসক্ত হচ্ছে, তেমনি চুরি, ছিনতাই, মারামারি ও পারিবারিক কলহ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলছে। সরজমিন উপজেলার চৈত্রকোল ইউনিয়নের চককৃষ্টপুর গ্রামের হোপনাপাহান, চরণমিনজী ও মণ্ডল এক্কা, দানিসনগর গ্রামের বিরো পাহান, শীবলাল, বুদরাই, চুপিন, শুকটু, সোমরা ও লা-চান বাসুদেবপুর লালুপাড়া গ্রামের এতোয়া, রামাধার, বাবলু এক্কা, বুধু ও ফেকুনি, পুত্রিপাড়া (চৈত্রকোল) গ্রামের শুকুরাম কেরকাটা, শুকচান, বিশ্বনাথ, বাসন্ত রানী ও মুকুল ড্রাইভার, টুকুরিয়া ইউনিয়নের ছাতুয়া গ্রামের সুনীল, বিরশা, মণ্ডল লাকড়া, সোমা, ভেরভেরি ও সান্ডোস কুজুরের বাড়িতে অবাধে চলছে চোলাই মদ তৈরি ও নেশার আসর দেখা যায়। কেউ বাড়ির আশপাশের ঝার-জঙ্গলে, কেউবা বাড়ির আঙ্গিনায় বসে একাধিক গ্যাস ম্যাচের আলোয় নেশা গিলছে। কেউ মদের নেশায় গলা ফাটিয়ে কথা বলছে, আবার কেউ গাঁজার কলকিতে (বাঁশি) টান দিয়ে বাড়ি মালিকের সঙ্গে কে কতটুকু মাল (চোলাই মদ) কিনবে তার খোশগল্প করছে। হঠাৎ সাংবাদিকের উপস্থিতি জানতে পেরে অনেকে মোটরসাইকেল ও অটো ভ্যানযোগে গাঢাকা দিলেও কেউ কেউ মাতলামির স্বরে বলতে থাকেন- ‘হামরাতো প্রশাসনক ট্যাকা দেই, তাও ক্যান ওরা আসপি!’ চোলাই মদ বিক্রেতা পুত্রিপাড়া (চৈত্রকোল) গ্রামের ট্রাক্টর ড্রাইভার মুকুল বিড়বিড় করে তার ঘরে বসা মদের মজমা থেকে বের হয়ে বলেন, ‘দাদা- হামরা এ গ্রামের সব্বায় প্রত্যেক দিন আফজাল চকিদারক (স্থানীয় গ্রাম্য পুলিশ) এক-দেড়শ করে ট্যাকা দেই। যাতে মেম্বার, চেয়ারম্যান আর পুলিশ যেন না আসে।’ ওই এলাকাতেই ৪/৫ জন যুবক প্রত্যেহ ইয়াবা (বাবা) ও ফেনসিডিল বিক্রি করে আসছে বলে স্থানীয়রা জানায়। ছাতুয়া গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি ভেরভেরি কুজুর। তার ইটের প্রাচীরে ঘেরা দালানের ঘর-বাড়ি। ওই বাড়িতেই তৈরি হয় মণকে মণ চোলাই মদ। মদ কেনার জন্য শুধু এলাকা নয়, পাশের মিঠাপুকুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলা থেকেও আসে মাদক ব্যবসায়ীরা। বাড়ির বাইরে দাঁড় করা কয়েকটি মোটরসাইকেল ও অটো চার্জার ভ্যান। হঠাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে এলো দুই যুবক। সঙ্গে দুটি ব্যাগ। ব্যাগ দুটো মোটরসাইকেলে বেঁধে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সটকে পড়ে। বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখা গেল ১০-১২ জন লোক। কেউ চেয়ারে বসে কেউবা বিছানায় বসে চোলাই মদ ও গাঁজার নেশায় মগ্ন। এদের ১ জন মামুনুর রশিদ। সে নবাবগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর থেকে এসেছে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতেই সে জানায়, ‘ভাই, আমরা আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। একটু খাওয়ার অভ্যাস আছে তো, তাই এখানে। এরপর অপর সঙ্গী মাসুদকে ডেকে নিয়ে দ্রুত কেটে পড়ে। স্থানীয় পরিমল কুজুর জানায়, ওরা দুজন ইয়াবা আর ফেনসিডিলের পার্টি। সপ্তাহে ৩-৪ দিন ওরা এখানে এসে মাল দিয়ে যায়। এরই মধ্যে প্রতি ঘরে তালা লাগিয়ে নারী-পুরুষ সবাই লাপাত্তা। অভিন্ন অবস্থা পীরগঞ্জের শানেরহাট, চতরা, রায়পুর ও বড়দরগা ইউনিয়নের আদিবাসী পল্লীগুলোতে। এ ব্যাপারে ওসি (তদন্ত) হারুন-অর-রশিদের সঙ্গে কথা হলে বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ী যে-ই হোক তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চলতি মাসেই মাদকের ৮টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ৫টিই আদিবাসীদের। অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031