ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে জাতীয় জাগরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যেই। এই নীতি-আদর্শের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন উপাদানকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়নি বলে এর একটা দুর্বলতা থেকে গেছে বলে মনে হয়। কিন্তু এ থেকেও আমরা বাংলাদেশের কেমন লক্ষ্যাদর্শ হওয়া উচিত তার একটা উত্তর খুঁজতে পারি। যদি আমরা এ অঞ্চলের ইতিহাসের দিকে নজর দিই তা হলে দেখব বাঙালি কোনোকালে শাস্ত্রপন্থি কট্টর জনগোষ্ঠী ছিল না, একটা কৃষিজীবী সমাজ যেভাবে পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধনে থেকে সফল হয় এখানে পরিবেশ তেমনটাই ছিল। এখানকার প্রকৃতি পরিবর্তমান হলেও মানুষের জন্য অত্যন্ত উদার ও সম্পন্ন ছিল। এ মানুষ প্রকৃতিলগ্ন, ভাববাদী এবং মানবিক। বাঙালির একান্ত অধ্যাত্ম সাধনা- যেমন হিন্দুদের গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন, মুসলিমদের বিভিন্ন ধারার সুফি সাধনা, বৌদ্ধদের তান্ত্রিক ধারাসমূহ এবং এ অঞ্চলের নিজস্ব আউলবাউল সহজিয়া সাধনা- বিচার করলে তাতেও পাওয়া যাবে এর প্রকৃতিলগ্নতা, ভাববাদ ও মানবিক আবেদন ইত্যাদি। ষোড়শ শতকের বৈষ্ণব কবির ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এ ঘোষণার ঔদার্য দেখে যেমন তেমনি সপ্তদশ শতকের মুসলিম কবির মাতৃভাষা-প্রেমের জোর দেখেও চমকে যেতে হয়। এই ইহজাগতিক মানবিক উদার ঐতিহ্যের ধারা থেকেই বাংলাদেশে একটি অসাম্প্রদায়িকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রণোদনা পাওয়া সম্ভব। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তর্নিহিত প্রবণতা এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে মানবিক উদার হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।
সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ছাড়াও আমরা যদি পাকিস্তান আমলের রাজনৈতিক গতিধারা লক্ষ করি তা হলেও দেখব বায়ান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি (ছাত্র আন্দোলন), ছেষট্টি, আটষট্টি (সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন), ঊনসত্তর (গণঅভ্যুত্থান), সত্তর (নির্বাচন) ও সবশেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেরণা ছিল এই একইভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। সেভাবেই স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে বাহাত্তরের সংবিধান রচিত হয়েছিল।
বায়ান্ন থেকে উপরিকাঠামোয় বা বহিরঙ্গে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জাগরণের ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটেছে যে ইতিহাসে জমে ওঠা বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ইস্যুর গ্রন্থিমোচন করার অবকাশ যেন পাওয়া যায়নি। কিংবা সে রকম প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা আমাদের নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীসমাজ দেখাতে পারেননি।
বাংলাদেশে বর্তমান রাজনীতিতে যে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে তার একেবারে ওপরে আছে ক্ষমতা ও বিত্তের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এটা লুটেরা ধনী ও সাধারণ লুটেরা শ্রেণির দ্বারা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়া। কিন্তু তা প্রশ্রয় পেয়েছে যখন স্বাধীন বাংলাদেশকে তার অর্জিত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক এবং উদার মানসিকতার ধারা থেকে সরিয়ে এনে ধর্মভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদে ঠেলা দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয় তখন থেকে। মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে ব্যর্থ করার এই চেষ্টা যে বিফল হয়নি তারও দুটি কারণ আছে। একদিকে রয়েছে স্বাধীনতার অর্জনকে যথার্থভাবে উপলব্ধি ও ব্যবহারে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা, বাম প্রগতিশীল শিবিরের বিভক্তি ও অবক্ষয়, পশ্চিমের উদার গণতান্ত্রিক দেশসহ বিশ্বব্যাপী রক্ষণশীলতার উত্থান, বাজার অর্থনীতির সুবাদে ভোগবাদী মানসিকতার প্রবল জোয়ার, সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম জাতি সম্পর্কে পশ্চিমের ভ্রান্তনীতি মিলে ক্রমে ক্রমে পঁচাত্তরের পরে সূচিত ধর্মীয় জাতীয়তার রাজনীতি শক্তি অর্জন করেছে। অন্যদিকে এই বাহ্য ঘটনাবলির পাশাপাশি বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তায় অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তির ফলে সৃষ্ট অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে।
এই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে কোনো জাতি এগোতে পারে না। এর ফলে সামাজিক সূচকে ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সত্ত্বেও ক্ষমতা ও বিত্তকে কেন্দ্র করেই মূল রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে- মানুষের অধিকার, আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শক্ত ভিত্তি ইত্যাদি চর্চা ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের বাইরে থেকে যায়।
এর সমাধান খুঁজতে হলে কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। ওপরের আলোচনা থেকে আমরা দুটি কারণকে প্রধান হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি- এক. বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তায় বিভ্রান্তি ও অসম্পূর্ণতা ছিল; দুই. এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির অনুকূল বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি প্রত্যাঘাত হেনেছে। একে কাটিয়ে ওঠার উদ্যম রাজনীতিতে দেখা যায়নি, আপসের নানা উদ্যোগ দেখা গেছে বরং।
বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ট্র–থ অ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশন গঠন করার মতো বাস্তবতা কখনো তৈরি হয়নি। কারণ স্বীকারোক্তি তো মূলত অপরাধ স্বীকার করলে অনুতপ্ত ব্যক্তিই দিতে পারেন। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতাকারীরা সে কাজ করেনি। তাই বঙ্গবন্ধু যখন একতরফা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন তা অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। ক্ষমার সুযোগ নিয়েছে অপরাধী, কোনো অনুতপ্ত মানুষ নয়। অনুতাপ ও স্বীকারোক্তির যে আচার খ্রিস্টীয় সংস্কৃতিতে আছে তা মুসলিম সমাজে কতটা গৃহীত হতো বলা মুশকিল। তবে স্বাধীনতার পরে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো পরিস্থিতিই অপরাধীদের বিচারের জন্য অনুকূল ছিল না। সমঝোতা ও ঔদার্য প্রদর্শনের জন্য বরং চাপ ছিল। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা যথেষ্ট শক্তি নিয়ে ক্ষমতায় এসে ইতিহাসের এই আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু তার পক্ষেও রাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাঙানো এখন বেশ কঠিন। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বিকার বরং ক্রমেই সমাজকে গ্রাস করছে। এদিকে নাগরিক সমাজও দুর্বল হয়ে পড়েছে। আজকের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে শক্ত ভিত্ দিতে হলে সঠিক রাজনীতি ও দৃঢ় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা দরকার। দরকার বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের স্বাধীনতা ও যথার্থ ভূমিকা। নাগরিক সমাজ যদি সে লক্ষ্যে কাজ না করে তা হলে সরকারি উদ্যোগও থমকে থাকবে।
আজ পুনরায় জাতির ঐক্যবদ্ধ জাগরণ এবং নানান সামাজিক আন্দোলন জরুরি। বঙ্গবন্ধুর মতো এ কাজে শেখ হাসিনাই পারেন যোগ্য নেতৃত্ব দিতে। একদিন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধ জাতি স্বাধীনতা এনেছিল, আজ তার কন্যার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কায়েম হতে পারে। কেননা সমাজের বিকার, জ্বরা বা মৃত্যু জাতির জন্য সর্বনাশ ডেকে আনে। তাই এই ক্রান্তিকালে রাষ্ট্র ও তার আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে চিন্তা ও চর্চা এবং বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত দরকার। এ কালের জীবনধারার সঙ্গে সনাতন ধর্মীয় মূল্যবোধের সংঘাত, নারীর অধিকারের সাম্প্রতিক সংজ্ঞা ও এ সম্পর্কিত ধর্মীয় বিধানের বৈপরীত্য ইত্যাদি সব বিষয় আলোচনায় আসা দরকার। এসব বিষয়ে স্বচ্ছ বিশ্লেষণ ও স্পষ্ট অবস্থান ছাড়া বাঙালি মুসলমানের পক্ষে সমাজের নবায়ন এবং আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সহজ হবে না।
হয়তো মুসলিম সমাজের বহু বছরের চিন্তার জড়তা ও দৈন্য কাটিয়ে তার মানসজগতে পরিবর্তনের হাওয়া ঢোকানোর কাজটাকে বলতে পারি মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি পর্ব। অর্থনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি সমাজমানসের মুক্তির কাজটি এগিয়ে না নিলে আমাদের অগ্রগতি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আর সেজন্য বলতে হয় বিজয়ের এই দিনে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন এবং তার পর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পথে জাতি এগোতে পারবে। সেদিক থেকে নতুন প্রজেক্টের কাছে দ্বিতীয় পর্বের মুক্তিযুদ্ধের ডাক পৌঁছে দিতে হবে। তাদের বিজয়ের মাধ্যমেই চূড়ান্ত বিজয় অর্জন সম্ভব হতে পারে।
