দেশে প্রায় সব জায়গাতেই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে । প্রতিদিনই কয়েক হাজার মানুষ নানা উপসর্গ নিয়ে পরীক্ষা করছেন। এর মধ্য দিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা চার থেকে পাঁচশর মধ্যে থাকছে। চলমান পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। করোনার উপসর্গের কিছুটা নিজের মধ্যে দেখা দিলে পরীক্ষা করাতে আগ্রহী হচ্ছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের নির্ধারিত হটলাইন নম্বরে কল করলে টেকনোলজিস্ট বা স্বাস্থ্যকর্মীরা এসে নমুনা নিয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ নির্ধারিত হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করাচ্ছেন। নমুন সংগ্রহের জন্য যতটা অনুরোধ হ্টলাইনে করা হয়, সেই তুলনায় মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা অপ্রতুল। তাই পরীক্ষায় আগ্রহী ব্যক্তিকে কয়েকদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। আবার কেউ নিজে থেকে হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করাতে চাইলেও তাতে ঝুঁকি থাকে। যিনি পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন, তিনি যদি পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা না করেন তাহলে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। কারণ হাসপাতালে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি বা অন্যরোগীরা যান। কার দেহে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ আছে তা পরীক্ষা না করে বলাও কঠিন। ব্যক্তি যদি আক্রান্ত নাও হয়ে থাকেন, দেখা গেল হাসপাতালে গিয়ে তিনি অজান্তেই আক্রান্ত হতে পারেন। তাই চিকিৎসকরাও বলছেন, ঘরে থেকে চিকিৎসা নিতে। শারীরিক অবস্থা খুব বেশি খারাপ না হলে হাসপাতালে যেতে নিরুৎসাহিত করছেন। বলা হচ্ছে, ৮০ ভাগ করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ঘরে থেকে সম্ভব। কেবল তাকে নিয়মিত চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।

ওদিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনা সন্দেহে রোগীদের নমুনা সংগ্রহের জন্য একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে শারীরিকভাবে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। এজন্য প্রত্যেককে (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম) পিপিই, মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহার করতে হয়। একজন রোগীর জন্য একটা পিপিই ব্যবহার হয়। এতে পিপিইর ব্যাপক ব্যবহারও হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ভ্রাম্যমাণ নমুনা সংগ্রহের ভ্যান বা গাড়ি তৈরি করে কাজ করছেন অনেকে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের ত্রিপুরায় এমনই ‘মোবাইল ভ্যান’ ডিজাইন করেছে। রোগীকে যেন হাসপাতালে যেতে না হয় এবং পিপিইর অপচয় কমানো যায়, তাই এ ব্যবস্থা নিয়েছে তারা।
তাদের এই পদ্ধতি বাংলাদেশেও অনুসরণ করা যায়। নমুনা সংগ্রহে ‘মোবাইল ভ্যান’ তৈরি করা যায়। এতে কর্মীদের জন্য পিপিইর অপচয় যেন কমবে তেমনি বেশি মানুষের পরীক্ষাও কম সময়ে করা যাবে। চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তাও বাড়বে। কারণ এতে রোগীর কাছাকাছি যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। কাঁচের দেয়ালের ওপাশ থেকেই তিনি নমুনা সংগ্রহে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে পারবেন। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে একজন থেকে অন্যজনের দেহে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক কমে আসবে। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো সবার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। তিনি যদি বাসা থেকে পরীক্ষা করাতে হাসপাতালে যান, তাহলে যে পরিবহন ব্যবহার করবেন সেখানেও ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। পরিবহন চালকও আক্রান্ত হতে পারেন। তিনি যেসব জায়গায় যাবেন সেখানে অন্যদের মধ্যেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কিন্তু আক্রান্ত বা অসুস্থ ব্যক্তির বাড়ির দুয়ারে ভ্যান পৌঁছে গেলে তাকে আর বাইরে ঘুরে বেড়াতে হবে না। এতে সংক্রমণের ঝুঁকিও কমবে। এ ধরনের ভ্যান তৈরিতে খুব বেশি ব্যয় হবে না। এতে যে খুব বেশি প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে, তাও নয়। খুবই সহজলভ্য। বরং এটি অনেক ক্ষেত্রে ব্যয়সাশ্রয়ী।
ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব গতকাল তাঁর ফেসবুক পেইজে এমন ‘মোবাইল ভ্যানের’ ছবি তুলে ধরেছেন। লিখেছেন, আগরতলা স্মার্ট সিটি কভিড-১৯ এর নমুনা সংগ্রহের জন্য একটি মোবাইল ভ্যান ডিজাইন করে তা পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকারীকের হাতে তুলে দেয়। এটা নমুনা সংগ্রহকারী চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে ও পিপিই-র অপচয় রোধ করে। তিন চাকার এই গাড়িটি সরু অলিগলিতে সহজে প্রবেশ করতে পারে ও সমগ্র কমিউনিটি থেকে নমুনা সংগ্রহ আরও সরলতর করে তুলবে। এখন রোগীদের হাসপাতালে স্যাতম্পল দেওয়ার জন্য যেতে হবে না। পাশাপাশি এটি অল্প সময়ে বড় মাত্রায় পরীক্ষা করতে সাহায্য করবে।’
এই উদ্যোগটি আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত বলে মনে করছি। আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের নীতি নির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে বিবেচনা করেন, তাহলে হয়তো নমুনা সংগ্রহ আরও বাড়ানো যাবে। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিও কমে আসবে।
এ কাজে জনপ্রতিনিধিরাও তাদের নিজেদের এলাকার মানুষের সুরক্ষায় এগিয়ে আসতে পারেন। সিটি করপোরেশনের মেয়র, সংসদ সদস্যরাও এ কাজে ভূমিকা রাখতে পারেন। তারা ব্যক্তিগত তহবিল থেকে এ ধরনের ভ্যান তৈরির উদ্যোগ নিতে পারেন, যা সংশ্লিষ্ট এলাকার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করতে পারেন। এ কাজে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও এগিয়ে আসতে পারে। তাহলে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের জন্যও কাজটি সহজ হয়ে আসবে। করোনাভাইরাসের মহামারি মোকাবিলা করতে হলে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছোট ছোট উদ্যোগ জাতীয় পর্যায়ে বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম। অতীতের নানা দুর্যোগেও সম্মিলিত প্রচেষ্টার এই নজির রয়েছে। লেখক: সাংবাদিক ও গল্পকার।
