বিদেশে যায় বিমানে। মাঝখানে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হয় ট্রানজিট হিসেবে। এরসঙ্গে জড়িত দেশি বিদেশি অপরাধী চক্রের সদস্য। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশকে মাদক চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে অপরাধীরা। তারা দেশের বিমানবন্দর ও বাংলাদেশস্থ স্থানীয়, আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসগুলোকে ব্যবহার করে সেগুলো পাচার করতে সাহায্য করে আসছে। এভাবে মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা চলে যাচ্ছে সারা বিশ্বে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এসব অপরাধের সঙ্গে বিদেশি অপরাধী চক্রও জড়িত। গত দুই বছর ধরে প্রত্যেক মাসেই বিমানবন্দর দিয়ে লাগেজের ভেতরে লুকিয়ে ও কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহারে ইয়াবা পাচার করে আসছে এই চক্রটি।

মাদকবিরোধী কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, চোরাচালানের মাধ্যমে দেশের বিমানবন্দর দিয়ে যাওয়া ইয়াবাগুলোর বেশিরভাগই যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের নানান দেশে। সর্বশেষ চলতি মাসের শুরুতে ইয়াবার একটি চালান আন্তর্জাতিক এক কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশ পাঠানোর চেষ্টা করেছিল ইয়াবা কারবারিরা। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে, আকাশে ওড়ার আগেই সেই চালান ধরে ফেলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, এসব কর্মকাণ্ডে বেশ কয়েকজন বিদেশি নাগরিকও জড়িত। তাদের সন্ধান পেতে সংস্থাটি ইন্টারপোলের কাছে সহায়তা চাওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব ইয়াবা মূলত অভিনব কৌশলে অপরাধীরা বিদেশ পাঠিয়ে থাকে। একেক সময় একেক কৌশল তারা ব্যবহার করেন। ফলে তাদের আটকানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিদেশি শ্রমিক, আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস, দেহের বিভিন্ন অঙ্গে করে এসব ইয়াবা দেশের বাইরে পাচার করা হয়। শুধু তাই নয়, প্রাপকের সঠিক নামও তারা ব্যবহার করছে না।
এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা সূত্র বলছে, চলতি বছরের জুন মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১৪টি চালানে ২১ হাজার ৬০০ পিস ইয়াবা বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। চালানগুলো বিদেশেই যাচ্ছিল। তবে চালানের প্রেরক ও প্রাপকের ঠিকানা ঠিক থাকলেও পরিচয় ভুয়া ছিল। ফলে প্রাপক অপরাধীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এটিও এক ধরনের কৌশল।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ছয় মাসে এমন ১৪টি চালানের ঘটনায় ৯টি মামলা ও চারটি জিডি করা হয়েছে। এ বছরের প্রথম চালান ধরা পড়ে জুন মাসের ৬ তারিখে। এরপর জুলাইয়ের ৫ ও ৬ তারিখে একই ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ার সার্ভিসে অভিযান চালিয়ে চালান আটক এবং মামলা দায়ের করা হয়। তাছাড়া নভেম্বরের ১১, ১৮ ও ২৪ তারিখে পর পর তিনটি অভিযান চালিয়ে বিদেশ যাওয়ার পথে ইয়াবার চালান আটক করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত মাদক চোরাকারবারিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও আরো বেশ কয়েকজনের ওপর নজরদারি করে তারা জানতে পেরেছেন, মিয়ানমার থেকে আনা এসব ইয়াবা চোরাচালানে বেশ কয়েকটি গ্রুপ জড়িত ছিল।
জানা গেছে, বিমানবন্দরে থ্রিডি স্ক্যানার না থাকায় ওই গ্রুপগুলো বিদেশি কুরিয়ার বা ডাক পরিসেবার মাধ্যমে সহজেই মাদক চোরাচালান করতে পারে। এমনি একটি অভিনব কায়দায় পোস্ট অফিসের মাধ্যমে বিদেশে ইয়াবা পাচারকারীর একটি চক্রের চার সদস্যকে আটক করেছিল খিলগাঁও থানা পুলিশ। এই চক্রটি জিপিওর কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে কাপড়ের পার্সেলের ভেতরে করে একটি দেশে ইয়াবা পাচার করতো। সর্বশেষ গত ৯ই নভেম্বর দেশের বাইরে দুই হাজার ৪০০ পিস ইয়াবার একটি চালান পাঠিয়েছে এ চক্রটি। ৬ই ডিসেম্বর এই চক্রের সঙ্গে জড়িত চারজনকে আটক করা হয়। আটক চার মাদকবিক্রেতাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ইয়াবা পাচারের এই অভিনব পন্থার তথ্য। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবে রাজধানীর গুলিস্তানের জিপিওতে সহায়তা চায় পুলিশ। সেখানকার কর্মকর্তাদের সহায়তায় পার্সেলটি খুঁজে বের করা হয়। ফলে দেশে থাকতেই বিপুল পরিমাণ ইয়াবার চালানটি আটকে দেয়া সম্ভব হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, এর আগেও একবার পোস্ট অফিসের মাধ্যমে দেশের বাইরে ইয়াবা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার চারজন সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে এসএ পরিবহনের মাধ্যমে পার্সেল আকারে আসা ইয়াবার চালানটি সংগ্রহ করেন। এরপর গত ৬ই ডিসেম্বর ইয়াবার চালানটি বিদেশে পাঠানোর উদ্দেশ্যে জিপিওতে জমা দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জিপিও কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ওই পার্সেলটি শনাক্ত করা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ও পুলিশের ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম-ফাইটিং ইউনিটের সামপ্রতিক অনুসন্ধান বলছে, ইয়াবার এসব ব্যাগগুলো বিদেশে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট শিপিং কোম্পানি বা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে থাকে। ডিএনসির বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারা যদি, ওই ব্যাগগুলো পরীক্ষা না করে বা অত্যাধুনিক স্ক্যানার ব্যবহার করা না হয়, তাহলে ব্যাগে থাকা ইয়াবা শনাক্ত করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আবার অনেক সময় ইয়াবা চোরাকারবারিরা অভিবাসী শ্রমিকদের লোভ দেখিয়ে তাদের মাধ্যমেই এগুলো পাঠিয়ে থাকে। এই ব্যাপারটিতে প্রবাসী প্রতিনিধিরাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তার ফলে গত বছরের ৫ই জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রবাসী প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, মাদক চোরাকারবারিরা প্রতারণার মাধ্যমে নিরীহ অভিবাসীদের দিয়ে ইয়াবা বহন করাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার পর লাগেজে ইয়াবা থাকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বাংলাদেশি নাগরিকরা। যা বাংলাদেশিদের জন্য খুব বিব্রতকর।
পাচারের ধারাবাহিকতায় গত মাসে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা পোশাক কারখানার জিনিসের একটি বাক্সের ভেতরে প্রায় ৩৯ হাজার ইয়াবা পেয়েছিল। সেই বাক্সটি কার্গোবিমানে করে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পাঠানোর কথা ছিল। তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরবর্তীতে এর সঙ্গে জড়িত থাকায় সন্দেহভাজন হিসেবে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএনসি কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএনসির এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কাছে আরো সাতজনের পরিচয় রয়েছে, যাদের মধ্যে একজন ইয়াবা চোরাচালানকারী একটি দলের প্রধান। বিমানবন্দরের ক্লিয়ারিং ও ফরওয়ার্ডিং এজেন্টদের সঙ্গে চোরাকারবারিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন, ঢাকা এয়ারপোর্ট সিঅ্যান্ডএফ এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, কোনো এজেন্ট জেনেশুনে ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত, এটা অবিশ্বাস্য। এটা তাদের অগোচরে হতে পারে। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা প্রয়োজনীয় নথি প্রস্তুত করে থাকে এবং কাস্টমস কর্মকর্তাদের সামনে প্যাকেজগুলো খুলে পরীক্ষা করে থাকে। সেখানে কোনোভাবেই এমন ঘটনা ঘটার কথা না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক গোয়েন্দা রামেশ্বর দাস, বিদেশে ইয়াবা চালান পাঠানোর ঘটনায় কয়েকটি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। তদন্তে প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, কুরিয়ার সার্ভিসে প্রেরকের যে ঠিকানা দিয়ে চালান পাঠানো হয়েছে, সেই ঠিকানায় ওই ব্যক্তিদের খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায়নি। এমনকি এনআইডি নাম্বার, নাম ঠিকানা বা ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেগুলোও ভুয়া ছিল। তবে ইতিমধ্যে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দূতাবাসকে চিঠি পাঠিয়েছি। তাছাড়া কুরিয়ার স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি সঙ্গে কথা বলেছি। কীভাবে এই ইয়াবা পাচার রোধ করা যায় সেই বিষয়ে। তবে তিনি বলছেন, বিদেশি চক্রটির ব্যাপারে আমরা পরিষ্কার না। তদন্ত করে আমরা আরো পরিষ্কার হতে পারবো।
এদিকে জানা যায়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ইতিমধ্যে কুরিয়ার সার্ভিস এসোসিয়েশন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কর্মশালা করেছে। কর্মশালায় তারা সুপারিশ করেছেন ব্যাংকের মতো কুরিয়ার সার্ভিসকেও জাতীয় পরিচয়পত্রের অ্যাক্সেস দিতে। সেক্ষেত্রে কেউ মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করার কোনো সুযোগ পাবে না। প্রাপক, প্রেরকের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার এবং জাতীয় পরিচয়পত্র চেক করে নিতে পারবে। পাশাপাশি কুরিয়ার সার্ভিসগুলো আধুনিক ও উন্নতমানের ড্রাগ ডিটেক্টর স্থাপন এবং ভালোমানের সিসি টিভির মাধ্যমে ভিডিও রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করবে।
এনআইডি এক্সেসের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, আসলে এভাবে এনআইডির পুরো অ্যাক্সেস দেয়া অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। এতে তথ্যের অপব্যবহার হতে পারে। তবে সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগলে, আমরা বেসিক কিছু তথ্যের অ্যাক্সেস দিতে পারি।
ডিএনসির অতিরিক্ত পরিচালক (ইন্টেলিজেন্স) মোসাদ্দেকুল হোসেন রেজা বলেন, আমরা এই বিষয়ে কাজ করছি। তদন্ত করে অতি দ্রুতই আমরা বের করবো এই অপরাধী চক্রকে। তবে তিনি বলেন, বিমানবন্দরের স্ক্যানার মেশিনগুলো আরো উন্নত করতে হবে। তাহলেই এগুলো রোধ করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের মধ্যে দেশ প্রেম লাগবে। যেটা হলে আরো কিছুর প্রয়োজন নেই।
ডিএনসির পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স) কুসুম দেওয়ান বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশকে মাদক চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। এই নেটওয়ার্ক উন্মোচনে আমরা কাজ করছি। আশা করি আমরা সফল হবো।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031