চিকিৎসকের অদক্ষতায় যুবমহিলা লীগের এক নেত্রী মৃত্যুর মুখে পড়েছেন রাজশাহীতে । অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে এখন প্রাণ নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে রোজিনা বেগম নামে ওই নারীর।
রোজিনা রাজশাহীর পবা উপজেলার নলখোলা গ্রামের শহিদুল ইসলামের স্ত্রী। তিনি হরিয়ান ইউনিয়নের আট নম্বর ওয়ার্ড যুব মহিলালীগের সাধারণ সম্পাদক। তার স্বামী শহিদুল ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য।
গত বৃহস্পতিবার রাজশাহী নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় অবস্থিত ‘মাইক্রোপ্যাথ ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ নামে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে গর্ভপাত ঘটাতে গিয়েছিলেন রোজিনা। সেখানেই ভুল চিকিৎসার শিকার হন তিনি। এখন মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি।
স্বজনরা জানান, রোজিনা বেগমের নাতি-নাতনি রয়েছে। তাই তিনি গর্ভধারণ করলেও সন্তান নিতে চাননি। এ জন্য গর্ভপাত করতে তিনি পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের স্থানীয় মাঠকর্মী জামেনা বেগমের পরামর্শ চান। জামেনা বেগম তাকে মাইক্রোপ্যাথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডা. শারমিন সেলিনা সুলতানার কাছে পাঠান।
গর্ভপাতের জন্য রামেক হাসপাতালের গাইনি বিভাগের চিকিৎসক শারমিন সেলিনা সুলতানার সঙ্গে তার আট হাজার টাকার চুক্তি হয়। গত বৃহস্পতিবার বিকালে মাইক্রোপ্যাথে তার গর্ভপাত শুরু করা হয়।
রোজিনার স্বজনদের দাবি, গর্ভের পাঁচ মাসের বাচ্চার হাত-পা কেটে কেটে বের করা হয়। এরপর তা একটি পাত্রে রাখা হয়। রোজিনার ছোট বোন এই কাটা হাত-পা দেখেছেন। এভাবে গর্ভপাত করায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় রোজিনার জরায়ু। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পেটের নাড়িও। এতে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকেন তিনি।
কিন্তু এই সময় ডা. শারমিন সুলতানা তাকে বিস্কুট ও পানি খেতে দেন। এগুলো খাওয়ার পর রোজিনার পেট ফুলে যায়। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন তিনি। রোগীর এমন অবস্থা দেখে তারা দ্রুত তাকে রামেক হাসপাতালে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু ডা. শারমিন সুলতানা তাকে চুক্তির আট হাজার টাকার জন্য আটকে রাখেন। তিনি সবাইকে বলতে থাকেন, টাকা না দেয়ার জন্য রোজিনা এমন অভিনয় করছেন।
পরে টাকা দিয়ে ওই ক্লিনিক থেকে ছাড়া পান রোজিনা। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রামেক হাসপাতালে। এরপর সেদিন রাত আটটা থেকে একটা পর্যন্ত হাসপাতালে রোজিনার অস্ত্রপচার করা হয়। এরপর তাকে ওয়ার্ডে দেয়া হয়। কিন্তু ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিলেন রোজিনা। তাই পরদিন শুক্রবার সকালে তাকে রামেক হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়।
রোজিনার ভাগ্নে আতিক হাসান জানান, আইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার দিন চিকিৎসক তার বাঁচার সম্ভাবনা দিয়েছিলেন এক শতাংশ। সেখানে দুদিন রাখার পর রবিবার সকালে রোজিনাকে আবার ওয়ার্ডে দেয়া হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শারিরীক অবস্থা আগের চেয়ে উন্নত। তবে তিনি পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত নন। সুস্থ হতে অনেকটা সময় লাগবে তার।
তিনি আরও জানান, রামেক হাসপাতালে অস্ত্রপচারের পর আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে তার মামীর আলট্রাসনো করা হয়। এতে পেটের ভেতর কাটা বাচ্চার মাথাসহ বিভিন্ন অঙ্গ দেখা যায়। রামেক হাসপাতালের দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অস্ত্রপচার করে সেগুলো বের করেছেন। এ নিয়ে তারা ডা. শারমিন সুলতানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবছেন।
রোজিনার স্বামী শহিদুল ইসলাম বলেন, পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মীর খপ্পড়ে পড়ে তার স্ত্রী ডা. শারমিন সুলতানার কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখেও টাকার জন্য এই চিকিৎসক তার স্ত্রীকে আটকে রেখেছিলেন। এতে তার শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়। এখন তার স্ত্রী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। শুধু চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। মাঝেমাঝে ভুল বকছেন। রোগী কিছুটা সুস্থ হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানান শহিদুল ইসলাম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত ডা. শারমিন সেলিনা সুলতানা বলেন, আমি রোগীকে ছুঁয়েও দেখিনি। সেদিন আমাকে না ডেকেই নার্স ডলি খাতুন রোজিনার গর্ভপাত করছিলেন। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে আমাকে ডাকা হয়। আমি গিয়ে দেখি, রোগীর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তাই আমি রোগীর গায়ে হাতই দিইনি। বিষয়টি মাইক্রোপ্যাথের ব্যবস্থাপকও জানেন।
তবে এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন ব্যবস্থাপক বুলবুল আহমেদ। বরং ডা. শারমিন সুলতানার দাবিই উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। বুলবুল বলেছেন, চিকিৎসক ছাড়া কোনো নার্সই এ ধরনের কাজ করবে না। একই কথা বলেছেন ক্লিনিকটির মালিক দেওয়ান আফতাব হাবিব খোকন। তবে কথা বলার জন্য ডলি খাতুনকে ক্লিনিকে পাওয়া যায়নি। তার সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রাজশাহীর ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. মুহাম্মদ এনামুল হক বলেন, এই ঘটনাটি সম্পর্কে তিনি অবহিত নন। থানায় কোনো মামলা হলে বা কেউ তার কাছে অভিযোগ করলে তিনি ঘটনাটি তদন্ত করে দেখবেন।
তিনি বলেন, পেটের বাচ্চার বয়স তিন মাসের বেশি হলে গর্ভপাত করার নিয়মই নেই। এই পাঁচ মাসের বাচ্চার গর্ভপাত করা মোটেও উচিৎ হয়নি।
