শরীর কারও কেউ গুলিবিদ্ধ, ঝলসানো । যন্ত্রণায় ছটফট করছে সবাই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাপসাপাতালের বার্ন ও প্লাষ্টিক সার্জারিসহ কয়েকটি ইউনিটে এমন ৯৩ জন রোহিঙ্গা রোগীর করুণ অবস্থা। কিন্তু এদের নেই চিকিৎসা ব্যয়ের কোন টাকা।
তবুও থেমে নেই এদের চিকিৎসা। প্রত্যেকের শরীরে লাগানো আছে স্যালাইন। খাওয়ানো হচ্ছে ওষুধ, লাগানো হচ্ছে যন্ত্রণা উপশমের মলম। গুলির ক্ষতস্থান ও ঝলসানো শরীর ব্যান্ডেজে মুড়িয়ে রাখার গজ থেকে সবরকম প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে ওরা। খাওয়ানো হচ্ছে খাবারও।
ওষুধ, চিকিৎসা উপকরণ, খাবারের খরচ যোগান আসছে কোথা থাকে জানতে চাইলেই চমেক হাসপাতালের ইউনিটগুলোর কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, রোগী কল্যাণ সমিতির তহবিলের অর্থে চলছে আহত রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা। যা জানেন না চিকিৎসাধীন রোহিঙ্গারাও।
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবুল কালাম জানান, চমেকের বার্ন ইউনিটে ১৭ জন পুড়ে যাওয়া রোহিঙ্গা রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। যাদের বেশিরভাগই ৫০ ভাগ ঝলসে গেছে। ফলে প্রত্যেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ অবস্থায় চিকিৎসা ব্যয়বহুল। কিন্তু এদের কোনো অর্থ নেই। তবুও থেমে নেই এদের চিকিৎসা।
একইভাবে হাসপাতালের ২৬ নং ওয়ার্ডের চিকিৎসক শাহনাজ পারভিন বলেন, এ ওয়ার্ডে ৫৩ জনের মতো রোহিঙ্গা রোগী রয়েছে। যাদের বুকে, পিটে, পায়ে, উরুতে, হাতে গুলিবিদ্ধ। এদের অনেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে। চিকিৎসা করানোর মতো এদের কোনো অর্থ নেই। তবে এদের চিকিৎসা চলছে ঠিকই।
হাসপাতালের ২৮নং ওয়ার্ডের চিকিৎসক মশিউর রহমান বলেন, এ ওয়ার্ডে ২৩ জন গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গা রোগী রয়েছে। যাদের নিজস্ব কোনো চিকিৎসা ব্যয়ের মতো অর্থ না থাকলেও চিকিৎসা সেবা চলছে।
চিকিৎসকরা জানান, গত ২৬ আগষ্ট থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চমেক হাসপাতালে ৯৩ জন রোহিঙ্গা রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। এছাড়া দু‘জন মারা গেছে। ১২ জন চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছে। একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় পালিয়ে গেছে। এদের প্রত্যেকের পেছনে মোটা অঙ্কের চিকিৎসা ব্যয় হচ্ছে।
চিকিৎসকরা আরও বলেন, চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা রোগীই গুলিবিদ্ধ। তাদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যেসব ওষুধপত্র হাসপাতালে আছে, সেসব তাদের দেয়া হচ্ছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় সব ধরনের সরঞ্জাম ও খরচ বহন করছে চমেক সমাজসেবা কল্যাণ অধিদপ্তরের রোগী কল্যাণ সমিতি।
রোগী কল্যাণ সমিতির সমাজসেবা কর্মকর্তা অভিজিৎ সাহা জানান, হাসপাতালে যেসব ওষুধ আছে, কর্তৃপক্ষ থেকে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। এর বাইরে বিভিন্ন পরীক্ষা, এমআইআর, সিটিস্ক্যান অর্থাৎ সুই-সুঁতো থেকে সব ধরনের খরচ রোগী কল্যাণ সমিতি থেকে দেয়া হচ্ছে।
তবে এখন পর্যন্ত তেমন খরচ না হলেও সামনে অনেক খরচ হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এতদিন পর্যন্ত ওষুধপত্র সরবরাহ করা হলেও সামনের সপ্তাহ থেকে তাদের অস্ত্রোপচার শুরু হবে। তখন অনেক খরচ হবে।
২৬ নম্বর ওয়ার্ডে যেসব রোগী আছে, তাদের ইমপ্ল্যান্ট (হাড়ভাঙা রোগীদের হাড় জোড়া না লাগলে পাত লাগানো হয়) করতে হবে। ইমপ্ল্যান্টের খরচ আট হাজার থেকে শুরু হয়ে ২০-২৫ হাজার পর্যন্তও আছে। একটি এমআইআর টেস্টের জন্য খরচ হয় প্রায় ৬ হাজার।
শতাধিক রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিলেও এখনো ৯৩ জন রোহিঙ্গা ভর্তি আছে। রোগীদের মধ্যে ৯৫ শতাংশই গুলিবিদ্ধ, অনেকে বোমা বিস্ফোরণের কারণে আগুনে পুড়ে ঝলসে গেছে, কেউ কেউ আঘাতে চোখ হারিয়েছে। এদের সবাইকে সমস্যার ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী রোগীই আছে।
মঙ্গলবার রাতে চমেক হাসপাতালে ভর্তি হন ৮০ বছরের বৃদ্ধ শাহাব মিয়া। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এই বৃদ্ধ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসা নিতে আসেন। কোনোমতে যেখানে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছেন, সেখানে রোগী কল্যাণ সমিতি নি:স্ব এই বৃদ্ধের চিকিৎসার ভার নেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি বলেন, এখন আর বয়স নেই, তবুও বাঁচতে ইচ্ছে করে। তাই প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি। কিন্তু চিকিৎসা করানোর জন্য টাকাও আমার কাছে নেই। এখানকার রোগী কল্যাণ সমিতি আমাদের চিকিৎসার খরচ দিচ্ছে জানতে পেরেছি। এর জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ।
একজন রোগী সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার খরচ চালিয়ে যাওয়া হবে বলে জানান সমাজসেবা কর্মকর্তা অভিজিৎ সাহা। তিনি বলেন, একজন রোগী চিকিৎসা শেষ করে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত রোগী কল্যাণ সমিতি সাহায্য করবে। কোনো রোগে আক্রান্ত রোগীই হোক না কেন, কাউকে ফেরানো হবে না।
তবে রোগী কল্যাণ সমিতি ছাড়াও অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে চিকিৎসার খরচ বহন করছেন বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, কোনো কোনো সংস্থা কিছু রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার খরচ বহন করছে। পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও কেউ কেউ সাহায্য করছেন। আমরা তাদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি। তারা যোগাযোগ করে তাদের চিকিৎসার খরচ বহন করছেন।
চমেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জহিরুল ইসলাম বলেন, এখনো পর্যন্ত সঠিক কোনো তালিকা না হলেও প্রায় ৯৬ জন রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিতে চমেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের কেউ পালিয়ে আসতে গিয়ে গুলি খেয়েছেন, কেউ সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইনে ঝলসে গেছেন। তবু বাঁচার আশায় সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকে পৌঁছেছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
তিনি জানান, ২৬ আগস্ট থেকেই চমেক হাসপাতালে রোহিঙ্গা রোগীদের চাপ বেড়েছে। এর আগে অল্প কয়েকজন থাকলেও গুরুতর আহতরা কেউ কেউ নিজেই এসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, আবার অনেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কক্সবাজার সদর হাসপাতাল থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এখানে এসেছেন।
