রাজধানীর সাততলা বস্তি এলাকায় বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (বিএমআরসি) ভবনের সামনে আড্ডা দিচ্ছেন ২০/২৫ জন যুবক। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা।একজন অন্যজনের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে উঠেছেন। কেউ কেউ মোবাইলে ছবি তুলছেন। তুলছেন সেলফিও। তাদের কারো মুখে
নেই মাস্ক। তাদের ঘিরে আশপাশের লোকজন ভীড় করছেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে কোনো বালাই নেই।
রাজধানীর মহাখালী জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট সংলগ্ন সাততলা বস্তি। বাংলাদেশে বৃহত্তম দু’টি বস্তির মধ্যে এটি একটি। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বাস। নিম্ন আয়ের মানুষজন এখানে সংগ্রাম করে বাঁচেন। করোনার এই মহামারির সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়না সেখানে। মাস্কের ব্যাবহারও প্রায় শূন্যের কোটায়। বস্তির কেউ করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর কোনো সঠিক তথ্য নেই। জ্বর কিংবা ঠাণ্ডা জাতীয় রোগে অসুস্থ হলে, বস্তির ভেতরে গড়ে ওঠা ফার্মেসিগুলোর ওষুধে সারছে রোগ। করোনার লক্ষণ থাকলেও নমুনা পরীক্ষা করাতে চায় না কেউ। অনেকেই বলছেন, বস্তির মানুষ পরিশ্রমী। তারা সব সময় পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সময় কাটায়। ফলে করোনা হলেও নিজেদের অজান্তেই তারা সুস্থ হয়ে ওঠেন।
স্থানীয়রা জানান, ‘করোনা বস্তিতে হয় না। এসি রুমে যারা থাকেন, তাদের এই রোগ হয়। বস্তিবাসী কঠিন পরিশ্রম করে এজন্য করোনা হওয়ার লক্ষণ নেই। বস্তিতে করোনা হলে, এতদিনে তো মহাবিপদে পড়তো সাততলা বস্তির মানুষ। কারণ যেই গিঞ্জির মধ্যে বসবাস। কেউ আক্রান্ত হলে পুরো বস্তিতে ছড়িয়ে পড়তো।’ এ নিয়ে সংক্রমণ ব্যাধি হাসপাতালের সামনে কথা হয় রিকশাচালক ইউসুফ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের বস্তিতে কারো করোনা হয়নি। আমার আশেপাশের লোকজন অনেক ভালো আছেন। অন্যান্য সময়ের মতো জ্বর আসলে, ডাক্তারের দেয়া ওষুধ খেয়ে আমরা সুস্থ হয়ে যাই।
বিএমআরসি ভবনের সামনের ফুটপাথে সেলাই মেশিনে কাজ করছেন সোনিয়া। তিনি মানবজমিনকে বলেন, সাততলা বস্তিতে কতো মানুষ আছেন তার সঠিক হিসেব কারো জানা নেই। করোনায় কেউ আক্রান্ত হওয়ার সঠিক তথ্য তার কাছে নেই। লোকমুখে শুনেছি কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছেন। তারা নিজ ঘরে আইসোলেশনে ছিলেন। এমআরসি কর্মীরা তাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। তবে এখন আর কেউ আক্রান্ত হওয়ার খবর পাচ্ছি না।
তালুকদার মেডিকেল হলের কর্ণধার মঞ্জু রহমান বলেন, বৃহত্তম এই বস্তিতে সবার খোঁজ রাখা অনেক কষ্টের। নিয়মিত ফার্মেসিতে ওষুধ বিক্রি করি। নানা রকম মানুষ আসে ওষুধ নিতে। কাউকে করোনায় আক্রান্ত হতে শুনিনি। করোনায় কেউ আক্রান্ত হলেও হয়তো নিজে নিজে সেরে গেছে। এখন পর্যন্ত এই বস্তিতে কেউ করোনায় মারা যায়নি। এখানকার মানুষ ধুলাবালিতে চলতে অভ্যস্ত, তারপরেও কারো মধ্যে করোনার লক্ষণ দেখা যায়নি। কয়েকদিন আগে ২ জন জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হলে তাদের হাসপাতালে নিয়ে নমুনা শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। পরে আমার দোকান থেকে জ্বর আর সর্দির ওষুধ নিয়েছে। এখন তারা সুস্থ।
নূরুল ইসলাম ভাণ্ডারি নামের এক বৃদ্ধ বলেন, লকডাউনের সময় সারা দেশ থেকে করোনায় মৃত্যুর সংবাদ শুনেছি। তখনো কাজের খোঁজে এই বস্তির মানুষ বের হয়েছে। সবাই মিলেমিশে একত্রে চলেছে। কারো করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাইনি। মানুষের করোনা হয় শুনেছি, কোনো রোগী দেখি নাই।
নাজমা বেগম নামের এক গৃহবধূ বলেন, গত নভেম্বর মাসে আমার জ্বর হয়েছিল। একদিন পর আমার সন্তানেরও জ্বর ওঠে। তখন অনেক বেশি চিন্তিত ছিলাম। ভয়ও পেয়েছি। কোনো পরীক্ষা করতে পারি নাই। পরে স্থানীয় দোকান থেকে জ্বরের ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়েছি। জ্বরের কথা কাউকে বলি নাই, যদি ঘর থেকে বের করে দেয়। এই বস্তিতে এখন আর করোনা নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন এনজিও এসে খোঁজখবর নেয়। তারাও জানে না কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে কিনা। লতিফা নামের এক দোকানি বলেন, আমরা কাজ করে ভাত খাই। করোনায় আমরা আক্রান্ত হবো না।
এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করেপারেশনের ২০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নাছির মানবজমিনকে বলেন, সাততলা বস্তিতে প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। করোনাকালীন সময়ে অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন। আল্লাহর রহমতে কারো মৃত্যু হয়নি। আক্রান্তের সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। আক্রান্তের তথ্য পেয়ে অনেককেই আইসোলেশনে নিয়েছি। এছাড়া আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের কোয়ারেন্টিনে নেয়ার ব্যবস্থা করেছি। এখন আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম।
