মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা এখনো দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকছে নির্বিচারে হত্যা ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ায় প্রাণে বাঁচতে । প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে তারা আসছে এবং এখন ছড়িয়ে পড়ছে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার গ্রামগঞ্জে। গত সোমবার গভীর রাতে এবং মঙ্গলবার দিনজুড়ে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা ও লোকলয় ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।

এ পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও সংখ্যাটি ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার বলছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সূত্র। আর জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জেনেভায় গতকাল এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে, গত মাস থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১ লাখ ২৩ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।

এদিকে সোমবার গভীর রাত থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অন্তত ৩৯টি সীমান্ত এলাকা দিয়ে এক দিনেই এসেছে প্রায় ৫৭ হাজার রোহিঙ্গা। গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ৩০টি তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা-নির্যাতন শুরু হয়। এরপর থেকে ওই জনগোষ্ঠীর লোকজন বাংলাদেশে আসছে।

গত তিন দিনে সরেজমিনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ টেকনাফ ও উখিয়ার পাঁচটির বেশি রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিলেও অনেকে গ্রামগঞ্জে ঢুকে পড়ছে। সীমান্ত পার হওয়ার সময় রোহিঙ্গারা গত কয়েক দিনে তেমন কোনো বাধার মুখে পড়েনি বলে জানিয়েছে। টেকনাফ উপকূলে ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ‘রোহিঙ্গা শিবিরে’ পৌঁছে দেওয়ার জন্য জনগণকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

তবে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল মঙ্গলবার অনুপ্রবেশের সময় ২ হাজার ৬৭৮ জন রোহিঙ্গাকে প্রতিরোধ করা হয়েছে এবং তাদের পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু রাতের আঁধারে তারা ঢুকে পড়ছে।

কাল দুপুরে টেকনাফের নাইট্যংপাড়া, কেরুনতলি, হ্নীলার দমদমিয়া, জাদিমোরা, লেদা, আলীখালী, হোয়াইক্যং মিনাবাজার, কানজরপাড়া গ্রাম, ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবনসহ প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় দল বেঁধে রোহিঙ্গাদের অবস্থান লক্ষ করা গেছে।

ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবনে আশ্রয় নেওয়া রাখাইন রাজ্যের বলিবাজারের মাছ ব্যবসায়ী জকির আহমদ বলেন, সেনাসদস্যদের সঙ্গে নাডালা বাহিনী যুক্ত হয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর, দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাই স্ত্রী ও তিন ছেলেকে নিয়ে কানজরপাড়া সীমান্ত দিয়ে চলে এসেছেন। এর জন্য নৌকা দালালদের জনপ্রতি মিয়ানমারের মুদ্রায় ১০ হাজার করে দিতে হয়েছে।

জকির আহমদ বলেন, গত বছরের হামলা আর এ বছরের হামলার ধরন আলাদা। গত বছর যুবতীদের ধর্ষণ করা হতো। এবার সে রকম অভিযোগ তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

হোয়াইক্যং কানজরপাড়া গ্রামের একটি বাড়ির আঙিনায় নবজাতক কোলে বসে ছিলেন জোবেদা খাতুন (২৬)। মিয়ানমারের ছালিপ্রাং এলাকায় তাঁর শ্বশুরবাড়ি। স্বামী কামাল হোসেন পেশায় কাঠমিস্ত্রি। তাঁর ছোট ছোট সাত মেয়ে ও তিন ছেলে। চার দিন ধরে তাদের নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিতে খুবই কষ্ট হয়েছে এই দম্পতির। শেষ ঠিকানা কোথায় সেটা তাঁর জানা নেই।

নারী বিলের বাসিন্দা নজির আহমদ বলেন, রোববার তাঁদের গ্রামে হামলা চালায় সেনারা। এ সময় হেলিকপ্টার থেকে পানির মতো তরল পদার্থ বাড়ি বাড়ি ফেলা হয়। এরপর বিকেলের দিকে নাডালা বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনী এসে আগুন লাগিয়ে দিলে দাউ দাউ করে বাড়িঘর পুড়তে থাকে। ওই সময় এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করা হয়।

গতকাল সকালে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বেড়িবাঁধের ওপর দেখা যায়। নৌকায় নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এসেছে তারা। শাহপরীর দ্বীপ ইউপি সদস্য নুরুল আমিন বলেন, গতকাল এক দিনেই শাহপরীর দ্বীপে ঢুকেছে প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গা। মানবিক কারণে তাদের কেউ বাধা দিচ্ছে না।

স্থানীয় সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, গতকাল এক দিনেই শাহপরীর দ্বীপ, খুরেরমুখ, সাবরাং, মহেশখালীয়াপাড়া, নাইটংপাড়া, বাহারছড়া, বড়ডেইল, শাপলাপুর উপকূল দিয়ে ঢুকেছে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা। গ্রামগঞ্জে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গাদের শিবিরে পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। নৌকা দিয়ে রোহিঙ্গা পারাপার বন্ধ করতে আজ বুধবার সাবরাং, টেকনাফ ও বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে জেলে ও নৌকার মালিকদের নিয়ে পৃথক তিনটি সভা ডেকেছে উপজেলা প্রশাসন।

রোহিঙ্গারা জানায়, গতকাল ভোরে নাফ নদীর গোলারমুখ এলাকায় ৩৮ জন রোহিঙ্গাসহ একটি নৌকা ডুবে গেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যমতে, গতকাল এক দিনেই টেকনাফের নাইটংপাড়া, লেদা, জাদিমুরা, নীলা, কানজারপাড়া, হোয়াইক্যং, উখিয়ার মনখালী, ছেপটখালী, বালুখালী, রহমতেরবিল, আনজুমানপাড়া, ধামনখালী, নাইক্ষ্যংছড়ির আমবাগান, তুমব্রু, ঘুমধুম, আসারতলী, দোছড়িসহ অন্তত ৩৯টি পয়েন্ট দিয়ে ঢুকেছে প্রায় ৫৭ হাজার রোহিঙ্গা। এর মধ্যে টেকনাফ উপজেলায় ৪২ হাজার, উখিয়ায় ১০ হাজার ও নাইক্ষ্যংছড়িতে ৫ হাজার।

টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বসে থাকতে দেখা গেছে। কেউ কেউ গাড়িতে উঠে কক্সবাজারের দিকে চলে যাচ্ছে। সমুদ্র উপকূলের ‘কক্সবাজার-টেকনাফ’ মেরিন ড্রাইভ সড়কেও একই অবস্থা। রোহিঙ্গারা ইজিবাইক, জিপ ও অটোরিকশায় করে উখিয়া ও কক্সবাজারের দিকে ছুটছে।

সড়কে ইজিবাইকে মাইক লাগিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন এক যুবক। তিনি বলছেন, রোহিঙ্গারা গ্রামগঞ্জে ঢুকে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাদের রোহিঙ্গা শিবিরে পৌঁছে দিতে হবে। রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে কেউ টাকা-পয়সা বা অন্য কোনো মালামাল ছিনিয়ে নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নৌকা নিয়ে কেউ রোহিঙ্গা পারাপার করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্দেশক্রমে সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন ও টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, দলে দলে রোহিঙ্গারা গ্রামে ঢুকে পড়ছে। তাতে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই তাদের রোহিঙ্গা শিবিরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ চৌধুরী বলেন, মিয়ানমার সীমান্তে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে ৫০-৬০ হাজার রোহিঙ্গা।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031