বাংলাদেশে আছেন দীর্ঘ সময় ধরে। তারা বিদেশি। একসময় তাদের বসবাস ছিল রাজধানীর অভিজাত এলাকায়। এখন অবশ্য সেটি নেই। ঢাকার উপকণ্ঠে বিভিন্ন এলাকায় তারা বসতি গড়েছেন। খেলোয়াড়, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণ ভিসায় তারা এখানে এসেছিলেন। কিন্তু এখন আর সেই স্ট্যাটাস নেই। ‘প্রতারণা’ তাদের সব পরিচয় ছাপিয়ে গেছে। অন্তত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর খাতায় তা-ই! অভিযোগ উঠেছে, তারা মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লটারি জেতার বার্তা পাঠিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের কেউ কেউ নিজেকে ডলার ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেয়। এমন ২০ বিদেশি প্রতারকের সন্ধানে মাঠে নেমেছে এলিট ফোর্স র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ। তাদের হন্যে হয়ে খুঁজছেন র্যাব সদস্যরা। তাদের ধরতে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু এখনো এ চক্রকে কব্জায় আনা সম্ভব হয়নি। সূত্রমতে, গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি উত্তরা থেকে তিন নাইজেরিয়ান নাগরিককে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ঢাকায় আরো কয়েকটি অভিযানে প্রতারণার অভিযোগে একাধিক বিদেশিকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য বিভাগ। এ বিষয়ে র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল মো: আবুল কালাম আজাদ মানবজমিনকে জানান, দেশি এবং বিদেশিচক্রের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এ প্রতারকচক্র। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি নাগরিকরা বিভিন্ন প্রতারণায় জড়িয়ে পড়েছে। তাদের অধিকাংশই আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিক। ওই প্রতারকচক্রের সদস্যরা আগে উত্তরা এলাকায় বসবাস করতো। উত্তরা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বেড়ে যাওয়া এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ায় তারা এখন ওই এলাকায় থাকে না। তিনি আরো জানান, এখন ওই প্রতারকচক্র বাড্ডা, রামপুরার বনশ্রী এবং মিরপুর এলাকায় বসবাস করছে। দেশি প্রতারকচক্র মনে করে, বিদেশিরা অন্য দেশের নাগরিক হওয়ায় বাংলাদেশিদের কাছে সহজেই তারা আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করতে পারবে। এজন্য তাদের পেছনে থেকে দেশীয় প্রতারকরা সহযোগিতা করে থাকে। তাদের ইতিমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, যে ২০ জন বিদেশি নাগরিককে শনাক্ত করা হয়েছে তারা ৫ থেকে ৭ বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এদের মধ্যে ৫ জন নারী প্রতারক রয়েছে। তারা কেউ এসেছে ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবের খেলোয়াড় ভিসায়, কেউ ব্যবসায়ী অথবা কেউ ভ্রমণ ভিসায়। তাদের অধিকাংশেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য তারা নতুন করে ইমিগ্রেশন বিভাগে আবেদন করেনি। কারো কারো পাসপোর্টই নেই। বিনা পাসপোর্টে তারা দীর্ঘদিন বাংলাদেশে বসবাস করছে। তারা বাংলাদেশে থাকা বিভিন্ন দেশের বৈধ নাগরিকের বাসায় বসবাস করছে। বৈধ বিদেশি নাগরিকের বাসায় খুব একটা অভিযানে যায় না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশের বৈধ নাগরিকের বাসাগুলোতে তারা আশ্রয় নিয়ে রয়েছে। কেউ কেউ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া করে আছে। র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রাথমিকভাবে যে ২০ বিদেশি নাগরিকের তালিকা তৈরি হয়েছে তারা হলো: জামিয়ানা নাওতু (৩৫), ভেক্টর রেক (৩৩), ইকতেপাকুকে বাইন (৪০), ওতাবিন কালিবা (৩৩), সলিজা নাইডু (৪০), সুলাইফা কলেবি (২৭), নুরবা সারিয়ানা (৩৪), সিকি নাদুবা (৩০), সারিয়ান বেবিক (৩২), সুদাবু নুরাবিন (৩২), সিমকো দুরাবিন (৪০), সুজাতু মরসেবু (৩৪), আনারু জাবাগা (৩৬), গুনকো তেবু (৩৭), সামুয়েলর্স বান (৪০), টিটু কুতুবি (৪০), শাউলেস সেবুস (৪২), সুমবুন কাওতান (৩৩), হাতুরিকন মাউতু (২০) ও মিস্টার রেকি সান (৪০)। ওপরের ক্রম অনুযায়ী নারীসহ ১০ জন হচ্ছে আফ্রিকা মহাদেশের রাষ্ট্র নাইজেরিয়ার নাগরিক, ৫ জন উগান্ডার এবং ৪ জন সেনেগালের। শুধু রেকিসান ইউরোপিয়ান ডাচ নাগরিক। র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রের তথ্যমতে, এই ২০ মধ্যে আনারু জাবাগা, গুনকো তেবুও সামুয়েলর্স বানকে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কিন্তু তারা আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারো ওই প্রতারণার কাজে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও অন্যরা এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিককে বিয়ে করে বসবাস করছে। তাদের ধরতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে র্যাব। সূত্র জানায়, ওই প্রতারকচক্র দুটি বিষয়ে প্রতারণা করে থাকে। তারা নিজেদের ডলার ব্যবসায়ী অথবা লটারির এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দেয়। তারা রাজধানীতে বসবাসকারী বিভিন্ন বক্তিদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে মোবাইলে এসএমএস পাঠায়। তারা এসএমএসে ওই ব্যক্তিকে জানায় তিনি লটারি জিতেছেন। ওই লটারিটি হচ্ছে কোকাকোলা অথবা আইসিসি টুর্নামেন্টের শ্রেষ্ঠ দর্শকের পুরস্কার। ওই পুরস্কার পেতে হলে তার নম্বরে যোগাযোগ করতে বলে। পরে ওই ব্যক্তি তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তার কাছ থেকে ওই প্রতারকরা পুরস্কার এনে দেয়ার নামে ৫ শতাংশ কস্ট ট্রান্সফারের নাম করে বিকাশ অথবা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ আদায় করে থাকে। সূত্র জানায়, এছাড়াও তারা নিজেদের ডলার বিক্রির মাধ্যমে প্রতারণার কাজ করে থাকে। তারা বাংলাদেশি অল্প টাকায় বেশি ডলার দেয়ার প্রলোভন দেয়। সরল বিশ্বাসে ফাঁদে পা দিয়ে ওই ব্যক্তি তাদের কাছ থেকে ডলার ক্রয় করে। পরে ক্রয়কারী জানতে পারেন ওই ডলার নকল। জানা গেছে, প্রতারকরা নিজেরাই এসব ডলার বাসায় বসে তৈরি করে।