ইউরোপের শহরে শহরে শপিং সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে । রাস্তাঘাট একেবারে খালি। ফলে পোশাক উৎপাদনকারী দেশগুলোর ক্রয়াদেশ অকস্মাৎ কমে গেছে। করোনাভাইরাসের কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। দেশটির সম্পূর্ণ অর্থনীতিই পোশাক রপ্তানির ওপর ব্যপকভাবে নির্ভরশীল। সরবরাহকারী থেকে শুরু করে গার্মেন্ট শ্রমিকরা এখন নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে সংগ্রাম করছেন। ফ্যাশন বিষয়ক ওয়েবসাইট ড্রেপার্স এক প্রতিবেদনে এমনটা জানিয়েছে।
এতে বলা হয়, ইউরোপে ঘরোয়া চাহিদা এখন একদমই নেই।

ফলে গণহারে ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে খুচরা বিক্রেতা কোম্পানিগুলো। ফলে বাংলাদেশের পুরো ইন্ডাস্ট্রির ওপর ব্যপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার মুখে। করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে ১১০০-এরও বেশি কারখানা বন্ধ ও প্রায় ৩.০৮ বিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। মার্চের শেষের দিকে সংগঠনটির সভাপতি রুবানা খান এক ভিডিও বার্তায় যেসব ক্রয়াদেশ সপন্ন হয়েছে সেগুলো গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “আমাদের প্রায় ৪১ লাখ শ্রমিক আক্ষরিক অর্থেই না খেয়ে থাকবে যদি আমরা সবাই শ্রমিকদের মঙ্গলের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার রক্ষায় এগিয়ে না আসি।”
তিনি বলেন, “একটি বিষয় স্পষ্ট: আমাদের প্রধান দায়িত্ব হলো আমাদের শ্রমিকদের প্রতি। আমরা একটি উৎপাদনশীল দেশ। আমাদের বাস্তবতা ও আপনাদের বাস্তবতা একেবারেই আলাদা। কিন্তু এখন বাস্তবতার পার্থক্য খুঁজে বের করার সময় নয়। এখন হলো এমন সময় যখন আমাদের একসঙ্গে কাজ করা উচিৎ।”
শ্রমিক অধিকার
লাখ লাখ শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে গেছেন। অনেকেই বেতন বা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। সেন্টার ফর গ্লোবাল ওয়ার্কার্স রাইটস গত মাসে এক প্রতিবেদনে জানায়, “বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি পোশাক সরবরাহকারীর সম্পন্ন বা প্রক্রিয়াধীন ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। ফলে অর্ধেকেরও বেশি কারখানা বন্ধ করতে হয়েছে। ক্রয়াদেশ যখন বাতিল হলো, ৭০ শতাংশ ক্রেতা ইতিমধ্যে ক্রয়কৃত কাঁচামালের অর্থ পরিশোধেও রাজি হলো না।”
চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট নামে একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, “ক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতা কোম্পানিগুলো এভাবে ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে, এমনটা কখনও দেখিনি।” তিনি বলেন, “পুরো শিল্পই থমকে যাচ্ছে। ক্রেতারা যদি উৎপাদনকারীদের অর্থ পরিশোধ না করেন, তাহলে তারা কীভাবে শ্রমিকদের বেতন দেবে? ক্রয়াদেশ ছাড়া কারখানাও চালু রাখা সম্ভব নয়। বিভিন্ন কারখানায় নিরাপদে কাজ করতে পারাটা বাংলাদেশের লাখ লাখ পরিবারের মূল উপার্জনের উৎস। তারা কীভাবে বাঁচবে যদি কারখানা চালু না থাকে?”
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ট্রেড সেন্টারের এথিক্যাল ফ্যাশন ইনিশিয়েটিভ-এর প্রধান ও প্রতিষ্ঠাতা সিমোন কিপ্রিয়ানি বলেন, “বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ বাতিল করার ফলে ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সমাজে। আমরা ইউরোপ-আমেরিকায় বসে যতটা চিন্তা করতে পারি, তার চেয়েও বেশি প্রভাব পড়বে।”
তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যবসা বাণিজ্যে যে প্রভাব পড়েছে, তা বেশ হাজে। কিন্তু তারপরও সেসব দেশে সামাজিক প্রভাব পুষিয়ে নেওয়ার নানা উপায় আছে। বাংলাদেশে শ্রমিকরা বাস করার মতো যথেষ্ট বেতন পায় না। ফলে কোনো ধরণের জরুরী অবস্থা সামাল দেওয়ার মতো আয় তাদের নেই। শ্রমিকদের কোনো আর্থিক সঞ্চয় নেই।” তিনি আরও বলেন, বিকল্প খুঁজে না পেলে অনেক শ্রমিকই অবৈধ পথে পা বাড়াবে। খুবই চরম কিছু ক্ষেত্রে, কেউ কেউ সন্ত্রাসবাদেও জড়িয়ে পেতে পারে।
রোগের হুমকি
পাশাপাশি, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কীভাবে এই করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তা নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। দেশটির জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। যদিও এখন পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্ত ও সংক্রমণের সংখ্যা অত্যন্ত কম। তারপরও ঘনবসতি ও অনেক এলাকায় সবসময় পানি না থাকার কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও ঘনঘন হাত ধোয়া সম্ভব হয়ে উঠে না।
বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় কাজ করা এক ব্যক্তি জানান, “উৎপাদন ব্যপকভাবে কমিয়ে আনা ছাড়া বাংলাদেশের মতো স্থানে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হলে সম্ভব নয়। দেশটি কীভাবে ভাইরাস মোকাবিলা করবে, তা নিয়ে উদ্বেগ আছে। গার্মেন্ট কারখানাতে শ্রমিকরা ১ মিটার বা আরও কাছে থেকে কাজ করে।”
লেবার বিহাইন্ড দ্য লেভেল নামে একটি সংগঠনের পলিসি ডিরেক্টর ডমিক মুলার বলেন, “এই ভাইরাস সকলকে আক্রান্ত করে। বৈষম্য করে না। তবে এই ভাইরাসের কারণে কে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার রকমফের আছে। আপনি যদি গার্মেন্ট শ্রমিক হন, আর আপনি যদি চাকরি হারান, তাহলে আপনাকে রাস্তায় থাকতে হবে। আপনাকে নতুন চাকরি খুঁজতে হবে। ফলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও থাকে অনেক। আমরা দেখছি ও শুনছি যে, কিছু কিছু কারখানা বলছে যে তারা পূর্বসতর্কতা নিচ্ছে। কিন্তু আদতে নিচ্ছে না।”
বাংলাদেশে যেন মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি না হয়, সেজন্য সাপ্লাইয়ার থেকে শুরু করে দাতব্য সংস্থা ও কারখানা মালিকদের সংগঠন থেকে বলা হচ্ছে যে, ক্রেতারাও যেন কিছু ভোজা গ্রহণ করেন। কিছু কিছু ক্রেতা রাজিও হচ্ছেন। যেমন, এইচঅ্যান্ডএম বলছে, ইতিমধ্যেই উৎপাদিত হয়ে যাওয়া পোশাক ও পণ্যের টাকা তারা দেবে। ইতিমধ্যেই দাম ঠিক হওয়া পণ্যের নতুন দামের জন্যও চাপ দেবে না সুইডিশ এই কোম্পানি। প্রাইমার্ক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাদের বাতিলকৃত ক্রয়াদেশের পণ্য উৎপাদনে যেসব শ্রমিক জড়িত ছিলেন তাদের বেতন পরিশোধ করবে তারা। কিন্তু পণ্য উৎপাদনে শ্রমিকদের বেতনই একমাত্র খরচ নয়।
মুলার বলেন, “অন্ততপক্ষে ক্রেতাদের উচিৎ ইতিমধ্যেই ঠিক হওয়া চুক্তিকে সম্মান করা। কিছু বড় ব্রান্ড চাইলে স্রেফ চুক্তিপত্র অস্বীকার করারও ক্ষমতা থাকে। কিন্তু যেই কাজ হয়েছে, সেই কাজের টাকা তাদের অবশ্যই দিতে হবে।” তিনি বলেন, “এখন এগিয়ে আসার সময়। অস্পষ্ট আচরণবিধির ওপর নির্ভর করে থাকার সময় নয়। ক্রেতাদের এ-ও নিশ্চিত করতে হবে যে, কারখানাগুলোতে বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার বিধিমালা অনুসরণ করে কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে কিনা।”
মুস্তাফিজ উদ্দিনও একমত। তার ভাষ্য, “ব্রান্ডগুলো চায় না তাদের সাপ্লাই চেন বন্ধ হয়ে যাক। পোশাক খাতের এই চেইনগুলোকে তাদের পরেওও প্রয়োজন হবে, যদি না সবাই পোশাক পরা বন্ধ করে দিই।”
বিলাসবহুল খুচরা বিক্রেতা ও ব্রান্ডগুলো প্রায়ই এই করোনাভাইরাসে কীভাবে টিকে থাকা যাবে, তা নিয়ে কথা বলে। কিন্তু বাংলাদেশে এই টিকে থাকাটা বহু শ্রমিকের জন্য আক্ষরিক অর্থেই অস্তিত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। অনেকের চাকরি হারিয়ে গেলে তারা দরিদ্র হয়ে পড়বে। এসব শ্রমিকদের ভালোমন্দের দায়িত্ব পুরো ফ্যাশন শিল্পের ওপর বর্তায়।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031