বাংলাদেশকে কবিগুরুর ভাষায় বলা হয় ‘সোনার বাংলা’। এই ‘সোনার দেশে’ মানুষ নিজে কর্ম করে বাঁচতে চায়। তা গ্রাম কিংবা শহর। সবাই নিজ উদ্যোগে নিজেকে সামলে নিতে অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের সেই চেষ্টায় বিষ ঢালে ‘অনিয়ম’ নামের এক ‘ভয়াবহ দানব’, যা সবকিছু গ্রাস করে ফেলছে। সবখানেই তার সরব উপস্থিতি। তাই অনেকে বলে থাকেন, ‘এই দেশে অনিয়মই এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে।’

এই দেশে নিয়ম ভাঙলে মানুষ ও পদ বুঝে শাস্তি হয়, তার উদাহরণের অভাব নেই। সাম্প্রতিক ঘটনার কথাই ধরুন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুনের পর বিস্ফোরণ হয়েছে। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থাকার কারণেই সেখানে বিস্ফোরণ হয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ওই কনটেইনারের ভেতর পোশাকসহ অন্য মালামাল রয়েছে।

আগুন নেভানোর সময় ডিপো কর্তৃপক্ষ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের কথা জানায়নি, এ তথ্য দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এর ফলে আগুন নেভাতে ও দেখতে যাওয়া এবং আগে থেকেই ডিপোর ভেতরে থাকা মানুষ বিস্ফোরণের সময় অক্ষত অবস্থায় ফিরতে পারেনি। কারও জীবন গেছে, আবার কারও অঙ্গহানি হয়েছে। ওই ঘটনায় ৬ জুন পর্যন্ত ৪১ জন মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে। আহত হয়েছে ৪০০ জনের বেশি। এত হতাহতের পরও দিব্বি নিজের পক্ষে সাফাই গাইছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক। তাদের কাছে এটা যেন কোনো ব্যাপারই না।

ওই ডিপোতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের মতো দাহ্য পদার্থ মজুত করার বিষয়ে কোনো অনুমতি বা অনুমতির তালিকায়ও ছিল না বলে জানিয়েছে বিস্ফোরক পরিদপ্তর। চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে সীতাকুণ্ডে ২৪ একর জমিতে ওই প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে প্রায় সাড়ে চার হাজার কনটেইনার ছিল। এতবড় কর্মযজ্ঞ চলছে অনুমতি ছাড়াই! এটা ভাবা যায়? এতদিন তারা কীভাবে অনুমতি ছাড়া দাহ্য পদার্থ মজুত করল, এটা তদারকির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কেন নেননি, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো তদন্ত কমিটি নামের এক ‘মহাজাগতিক’ প্রক্রিয়ার মাঝে আটকে যাবে। কোনোদিন তার সঠিক জবাব সাধারণ মানুষ জানবে না।

চট্টগ্রাম থেকে এবার ঢাকায় ফেরা যাক। দৃষ্টি দেই আরেক ভিন্ন একটি ঘটনার দিকে। ২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বাড্ডা এলাকার ব্যস্ত সড়কে একটি মোটরসাইকেলে আগুন দিয়েছিলেন একজন পাঠাওচালক। উপস্থিত জনতা সেই আগুন নেভাতে গেলে হেলমেট হাতে তাদের দিকে তেড়ে যান মোটরসাইকেলের সেই মালিক। একটু পরেই এই ঘটনার জট খোলে।

কেন এমন করেছিলেন, সেটি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন মোটরসাইকেলের চালক শওকত আলী। তিনি বলেন, রাইড শেয়ারিং অ্যাপের পরিবর্তে মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে যাত্রী পরিবহণের কারণে গত সপ্তাহে পুলিশ তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দিয়েছিল। এরপর যখন আবার পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলা দেবে বলছিল, তখন তিনি ক্ষোভে-দুঃখে নিজের গাড়ি নিজেই জ্বালিয়ে দিয়েছেন।

যানজনের এই ‘পাগলা হরিণ’র শহরে একটু স্বস্থি পেতে মানুষ মোটরসাইকেলে ওঠে। দ্রুত গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে সহায়তা করেন পাঠাও-উবার চালকরা। শিক্ষিত বেকারের উচ্চহারের এই দেশে তারা রাষ্ট্রীয় সহায়তা ছাড়াই নিজে টিকে থাকার যুদ্ধ করছেন। কিন্তু সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা। রাঘববোয়ালদের ধরার সামর্থ্য হারিয়ে তারা চুনোপুটিদের পেছনে ছোটে। এটাই এখানকার নিয়তি।

লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) বরাত দিয়ে গত ২৯ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক জানায়, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুজনে একজনের নাম বেকারের খাতায়।

এই বেকাররা চাকরির পেছনে ছোটেন। চাকরি না পেলে অন্য কিছু করার চেষ্টা করেন। তাদের সঙ্গে অশিক্ষিত বেকারের বিশাল একটি তালিকা যোগ হয়েছে। তারা নিজেরা কিছু করতে চান। সামান্য টাকায় চাকরি নামের ‘সোনার হরিণ’ ধরতে চান। কিন্তু চলার বা চাকরি করার মতো সুন্দর পরিবেশ তো দেওয়া হচ্ছেই না, বরং তাদের থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবনটাই চলে যাচ্ছে। এর বড় উদাহরণ পুরান ঢাকার নিমতলী, চকবাজার ও সাভারের রানা প্লাজার ঘটনা। সব জায়গায় অনিয়মের ছাপ। কোথাও নিয়ম মেনে, সঠিক পথে শ্রমিকদের কাজে লাগানো হয়নি। বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন মুনাফাভোগীরা। তাদের থামাতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

এতে করে শত শত প্রাণ যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ চিরতরে পঙ্গু হচ্ছে। তাদের পরিবারের সদস্যদের আহাজারি আমাদের চোখে পড়ছে না। এত প্রাণ যাওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চোখ খোলে না। অনিয়মের বেড়াজালে মুনাফা খুঁজতে যাওয়া ব্যক্তিদের কাছে এই প্রাণের দাম নেই। তাদের কাছে মৃত্যু একটি সংখ্যামাত্র। কিন্তু একটা জীবন যে কত মূল্যবান, তা শুধু ওই পরিবারই জানে। অন্য কেউ সেটা বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না। তাই তারা চোখ বন্ধ করে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মুনাফা খোঁজে।

জাকির হোসেন তমাল : জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আমাদের সময়

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031